You are currently viewing সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ১৭৬০-১৮০০খ্রিষ্টাব্দ
সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ১৭৬০-১৮০০খ্রিষ্টাব্দ

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ১৭৬০-১৮০০খ্রিষ্টাব্দ

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ প্রথম কোথায় শুরু হয় ?

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের বিস্তার ও পরিণতি ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় প্রথম সন্ন্যাসী-ফকিরেরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ক্রমশ বিদ্রোহের আগুন কোচবিহার, রংপুর, মালদা, দিনাজপুর সহ উত্তর ও পূর্ববঙ্গের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ নেতা কে ছিলেন ?

ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন মাদারিপন্থী পীর মজনু শাহ।

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের দুজন নেতার নাম লেখো।  

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের দু’জন নেতার নাম হল ভবানী পাঠক ও মজনু শাহ।

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ কবে হয়েছিল ? এবং আন্দোলনের গুরুত্ব বর্ণনা করো।

ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বলতে মূলত আঠারো শতকের শেষের দিকে (১৭৬০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ) ভারতবর্ষের বাংলাতে ফকির ও সন্ন্যাসী বা মুসলিম ও হিন্দু তাপসদের তৎকালীন ব্রিটিশ শাসন বিরোধী আন্দোলনকে বোঝানো হয়ে থাকে। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন মাদারিপন্থী পীর মজনু শাহ।

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো ?

হিন্দু মুসলিম ঐক্য: সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ হিন্দু মুসলিম ঐক্য লক্ষ্য করা যায়। অংশগ্রহণকারী বিদ্রোহী ও নেতৃবৃন্দের মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষই হয়েছিল। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের যোগদান: সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ মূলত কৃষিজীবী সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এই বিদ্রোহের যোগদান করেছিল।

ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ব্যর্থতা হওয়ার কারণ কি ছিল ?

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ফকির ও সন্ন্যাসীদের ব্যর্থতার মূল কারণ ছিল তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও দৃঢ় নেতৃত্বের অভাব, এটা সবাই স্বীকার করেন। তবে ফকির মজনু শাহকে এই বিদ্রোহে হারানো যায়নি। ফকির মজনু শাহর মৃত্যুর পরে ফকিরদের মধ্যে নেতৃত্বের কোন্দল ক্রমশঃ আন্দোলনকে দুর্বল করে দেয়।

ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ কি ? বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল উল্লেখ করো।

উপরন্তু ১৭৭০ সালে দুর্ভিক্ষে প্রায় এক কোটি মানুষ প্রাণ হারায় যা তৎকালীন বাংলার মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। ১৭৭১ সালে, ১৫০ জন ফকিরকে দৃশ্যত বিনা কারণে হত্যা করা হয়। এটি ছিল ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অন্যতম কারণের একটি যা তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং এই ক্ষোভ পরবর্তীকালে রূপ নেয় সশস্ত্র সংঘাতে।

উত্তরবঙ্গের সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের বর্ণনা দাও। 

সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ভারতবর্ষের প্রথম ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম । ১৭৭১ সালে, ১৫০ জন ফকিরকে হত্যা করা হয় দৃশ্যত বিনা কারণে। এটি ছিল অনেকগুলো কারণের একটি যা ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং এ ক্ষোভ পরবর্তীকালে রূপ নেয় সংঘাতে বিশেষত নাটোরে, রংপুরে যা এখন আধুনিক বাংলাদেশের অন্তর্গত।

ভূমিকা

ফকির-সন্ন্যাসীরা ছিল বাংলার অধিবাসী। এরা ছিল হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায় ভুক্ত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এক একটি দল। এরা সাধনায় সিদ্ধি লাভের উদ্দেশ্যে সারা বছর দেশের একস্থান থেকে আরেক স্থানে ঘুরে বেড়াতো। ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে উত্তর গোষ্ঠি পরিচিত ছিল। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিদ্রোহী হতে এবং অস্ত্র ধারণ করতে হয়। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই বিদ্রোহ চলতে থাকে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে উৎকটভাবে প্ৰকাশ পেয়েছিল বাঙালীর বিদ্রোহী মানসিকতার। এই সময়ের সব চেয়ে বড় বিদ্রোহ হচ্ছে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। এটা ঘটেছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পটভূমিকায়। ১৭৬০ খ্ৰীস্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্ৰীস্টাব্দের প্রথম ভাগ পর্যন্ত বাংলাতে চলা সন্ন্যাসী ও ফকির বা মুসলিম ও হিন্দু তাপসদের তৎকালীন ব্রিটিশ শাসন বিরোধী আন্দোলন বর্তমানে ইতিহাসের এক প্রায় ভুলে যাওয়া অধ্যায়। ঐতিহাসিক এই আন্দোলন ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামেও পরিচিত। ইতিহাসবিদগণ বিদ্রোহটির পটভূমি নিয়েই শুধু দ্বিধা বিভক্তই নন, বরং ভারতবর্ষের ইতিহাসে এর গুরুত্ব নিয়ে তাঁদের মধ্যে কিছুটা মতদ্বৈত্বতা লক্ষণীয়। কেউ কেউ একে বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকার বলে মনে করেন যেহেতু ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর খাজনা উত্তোলনের কতৃত্ব ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে তুলে দেওয়া হয়, আবার কারো কারো মতে এটি ১৭৭০ খ্ৰীস্টাব্দের দুর্ভিক্ষোত্তর বাংলায় কিছু দস্যুর উন্মত্ততা ছাড়া কিছুই না।

বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির শাসনের বয়স তখন মাত্র তিন বছর। ১৭৬০ সালের ৩০শে জুন, অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রংপুর অঞ্চল থেকে শুরু হয়েছিলো ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ।  ফকির মজনু শাহ এই বিদ্রোহের প্রাণপুরুষ ছিলেন। পরবর্তীতে নাটোরের জমিদার দেবী চৌধুরাণীর সেনাপতি সন্ন্যাসব্রতধারী ভবানী পাঠক এই বিদ্রোহে যুক্ত হয়ে হিন্দু বিদ্রোহীদের প্রেরণা ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রায় একই সময়ে রংপুর অঞ্চলের সাধারন কৃষক নূরুল উদ্দীনও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আপামর কৃষিজীবীদের সংগঠিত করে এই বিদ্রোহে অংশ নেন।

গবেষকরা মনে করেন, এই ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বস্তুত এক অভূতপূর্ব জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সূচনা করেছিল। সুদীর্ঘ ৪০ বৎসর যাবত পরিচালিত এই বিদ্রোহ ১৮০০ সালে শেষ পর্যন্ত কার্যত স্তিমিত হয়ে পড়ে। আবহমান বাংলায় মরমিধারার অনুরাগ ও আধিপত্যই মূলত এই বিদ্রোহের সারসত্ব ছিলো বলেও গবেষকরা দাবি করেন।

ফকির ও সন্ন্যাসীদের এই সুদীর্ঘ প্রতিরোধের কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থে লেখা হয়েছে, সম্ভবত কোম্পানি প্রবর্তিত রেগুলেশন দ্বারা মুসলিম ফকির ও হিন্দু সন্ন্যাসীদের জীবনযাত্রা বিভিন্নভাবে ব্যাহত ও বাধাগ্রস্ত হয় এবং এরই ফলে তাঁরা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

ফকির ও সন্ন্যাসীরা প্রধানত গ্রামাঞ্চলে তাঁদের অনুসারী ও সহমর্মী জনগণের নিকট থেকে দান গ্রহণ করে তার উপর ভিত্তি করেই জীবনধারণ করতেন। কখনো গান গেয়ে ভিক্ষা সংগ্রহও করতেন। আন্দোলনের শুরুর কথা কোম্পানি শাসকরা দেশের ধর্মীয় রীতিনীতি ও আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে মোটেও অবগত ছিল না; আর সে কারণেই ফকির-সন্ন্যাসীদের দান গ্রহণকে তাঁরা জনসাধারণের নিকট থেকে অননুমোদিত অর্থ আদায় বলে মনে করত। কাজেই কোম্পানি ফকির-সন্ন্যাসীদের সংগঠিত দল কর্তৃক দান গ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে ফকির-সন্ন্যাসীরা ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করে।

এই প্রতিরোধ আন্দোলন দেশের কৃষকশ্রেণির স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন লাভ করে। কারণ তাঁরাও কোম্পানি কর্তৃক প্রবর্তিত নতুন ভূমি রাজস্ব নীতির অধীনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আন্দোলনকারী ফকির-সন্ন্যাসীগণ ছিলেন মাদারিয়া সুফি তরিকার অনুসারী। এই সুফি তরিকা সতেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শাহ সুলতান সুরীয়া বুরহানার নেতৃত্বে বাংলায় প্রসার লাভ করে। সন্ন্যাসীগণ ছিলেন বেদান্তীয় হিন্দু যোগী এবং একদন্ডী সন্ন্যাসবাদের গিরি ও পুরী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ফকির ও সন্ন্যাসীগণ যথাক্রমে খানকাহ ও আখড়ায় বাস করতেন। সুফি ফকির ও যোগী সন্ন্যাসীদের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ও ধর্মাচরণে যথেষ্ট সাদৃশ্য ছিল। এই সাদৃশ্য ও একাত্মতা কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে তাঁদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মুল কারণ ছিলো অনেকটাই।

বাংলায় কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই স্থানে স্থানে কৃষকরা বিদ্রোহ করেছিল। মজনু শাহ, অনুপনারায়ণ, ভবানী পাঠক, পীতাম্বর প্রমুখ ব্যক্তিদের নেতৃত্বে কৃষকরা কিছু অঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কোম্পানির শাসকরা এদেরই সন্ন্যাসী ও ফকির নামে অভিহিত করেছিল। বিদ্রোহীদের অনেকে কিন্তু আক্ষরিক অর্থে সন্ন্যাসী ছিল না। প্রধানত মজনু শাহর নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা বর্তমান বিহারের বিরাট এলাকা সহ বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগঠিত করেছিল। মজনু শাহ বাংলার জমিন্দারদের তাঁর বিদ্রোহে যুক্ত হতেও আহ্বান জানান। কিন্তু তাতে সাড়া পাওয়া যায়নি।

এই বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে ঢাকায়। বিদ্রোহী কৃষকরা ইংরেজদের কুঠিগুলি আক্রমণ করে। হতচকিত ইংরেজরা আত্মরক্ষায় ব্যর্থ হলে বিদ্রোহীরা কুঠি লুঠ করে প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র হস্তগত করে নেয়। কিন্তু তারা এই সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি। দ্রুত ইংরেজ কুঠিয়ালরা জোটবদ্ধভাবে বিদ্রোহীদের দমনে উদ্যোগী হতে বিদ্রোহী কৃষকরা উত্তরের জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। বিদ্রোহীরা এই সময়ে কোচবিহার আক্রমণ করে রাজাকে পদচ্যুত পর্যন্ত করতে সমর্থ হয়েছিল। ঠিক এমনভাবেই অতর্কিতে বিহারের সারন জেলায় ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে কুখ্যাত জমিন্দার দেবী সিংহকে আক্রমণ করে মজনু শাহ তাঁকে পরাজিত করেন।

এইসব সংঘর্ষের পর ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহীরা রাজশাহীতে নিজেদের সুরক্ষিত কেল্লা স্থাপন করে বৃহত্তর যুদ্ধের সংগঠনেও সমর্থ হয়। বেশ কয়েক বছর উত্তর ও পূর্ব বাংলায় বিদ্রোহীদের সঙ্গে কোম্পানির সেনাদের ছোটোখাটো সংঘর্ষ লেগেই থাকত। কোনও পক্ষই চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করতে পারছিল না। কিন্তু বগুড়ার যুদ্ধে মজনু শাহ কোম্পানির সেনাদের হাতে পরাজিত হলে তাঁর সহযোদ্ধারাও একে একে উত্তরবঙ্গের নানা স্থানে পরাজয় বরণ করেন। বিদ্রোহের দাপট কিছুদিন কমে গেলেও বিদ্রোহ কিন্তু পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যায়নি। সাময়িক বিরতির পর বিদ্রোহীরা গোপনে সংগঠিত হয়ে কলকাতা আক্রমণের উপক্রম করলে কোম্পানির সেনারা অত্যন্ত চাতুরির সঙ্গে যশোহরের দখল নিয়ে নেয়। যশোহর শহরের নিকটবর্তী মোগলহাট নামক স্থানের যুদ্ধে বিদ্রোহীরা পরাজিত হয়। বিদ্রোহী নায়কদের অনেকে যুদ্ধে প্রাণ দেয়। এর পরই উত্তরবঙ্গে কোম্পানির সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে মজনু শাহ পরাজিত হলেন। বিদ্রোহীদের প্রধান ঘাঁটি রাজশাহী ইংরেজরা ধ্বংস করে দেয়। এরপরও সন্ন্যাসী-ফকিররা বাংলার নানাস্থানে সুযোগমতো কোম্পানির প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেও কোনো ফলপ্রসু হয়নি। বিদ্রোহী কিছু নেতাকে আটক করে বিচার করা হয় এবং অধিকাংশেরই ফাঁসি হয়।

ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহের কারণ

বাংলার ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহ। আঠারো শতকের শেষার্ধে এই বিদ্রোহের শুরু। এর আগে নবাব মীর কাশিম ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে ফকির-সন্ন্যাসীদের সাহায্য জন। এই ডাকে সাড়া দিয়ে ফকির-সন্ন্যাসীরা নবাবের পক্ষে যুদ্ধ করে। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মীর কাশিম পালিয়ে গেলেও ফকির-সন্ন্যাসীরা তাদের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে।

নবাবকে সাহায্য করার কারণে ইংরেজরা তাদের গতিবিধির প্রতি কড়া নজর রাখতে থাকে। বাংলার ফকির-সন্ন্যাসীরা তাদের রীতি অনুযায়ী ভিক্ষাবৃত্তি বা মুক্তি সংগ্রহের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। ধর্মীয় উৎসব, তীর্থস্থান দর্শন উপলক্ষে সারা বছর তারা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ঘুরে বেড়াত। তাদের সাথে নিরাপত্তার জন্য নানা ধরনের হালকা অস্ত্র থাকত। বাংলায় ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত তারা ছিল স্বাধীন এবং মুক্ত। কিন্তু ইংরেজ সরকার তাদের অবাধ চলাফেরায় বাধার সৃষ্টি করতে থাকে।

তীর্থস্থান দর্শনের উপর করারোপ করে, ভিক্ষা ও মুক্তি সংগ্রহকে বেআইনি ঘোষণা করে। তাছাড়া তাদেরকে ডাকাত দস্যু বলে আখ্যায়িত করতে থাকে। ফলে ক্ষুদ্ধ হয়ে ফকির সন্ন্যাসীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। বিদ্রোহী ফকির দলের নেতার নাম ছিল মজনু শাহ। আর সন্ন্যাসীদের নেতার নাম ছিল ভবানী পাঠক। তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল সরকারি কুঠি, জমিদারদের কাছারি ও নায়ের-গোমস্তার বাড়ি।

ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় সন্ন্যাসীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ শুরু করে। ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে মজনু শাহ সারা উত্তর বাংলায় ইংরেজ বিরোধী তৎপরতা শুরু করেন। ১৭৭৭ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া, ঢাকা, ময়মনসিংহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। তবে এ আন্দোলনের তীব্রতা ছিল উত্তর বঙ্গে। এই সব অঞ্চলে ইংরেজদের সঙ্গে বিদ্রোহী ফকির-সন্ন্যাসীদের বহু সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। এ সব সংঘর্ষে বিদ্রোহীরা অনেক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে এবং কোম্পানির বহু কুঠি লুঠ করে।

ফকির মজনু শাহর যুদ্ধ কৌশল ছিল গেরিলা পদ্ধতি, অর্থাৎ অতর্কিতে আক্রমণ করে নিরাপদে সরে যাওয়া। ইংরেজদের পক্ষে তাকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা কখনই সম্ভব হয়নি। তিনি ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করলে বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন মুসা শাহ, সোবানশাহ, চেরাগ আলী শাহ, করিম শাহ, মাদার বক্‌স প্রমুখ ফকির। এই নেতারা কয়েক বছর ইংরেজ প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে তারা চূড়ান্তভাবে প্রাজিত হয়। অদিকে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নেতা ভবানী পাঠক ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে লেফটেন্যান্ট ব্রেনানের নেতৃত্বে একদল ব্রিটিশ সৈন্যের আক্রমণে দুই সহকারীসহ নিহত হন। সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন তিনি। ফলে তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অবসান ঘটে।

ব্যর্থতার কারণ

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ফকির সন্ন্যাসীদের ব্যর্থতার মূল কারণ ছিল তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও দৃঢ় নেতৃত্বের অভাব। তাছাড়া মজনু শাহর মৃত্যুর পরে ফকিরদের মধ্যে নেতৃত্বের কোন্দল ক্রমশ আন্দোলনকে দুর্বল করে দেয়। ফকির-সন্ন্যাসীরা কোনো এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা ছিল না। ফলে বিদ্রোহীরা স্থানীয়দের সহযোগিতা সহানুভূতি পেতে ব্যর্থ হয়। অস্ত্র, রণকৌশল সবদিক দিয়ে তারা ইংরেজ সৈন্যদের সমকক্ষ ছিল না। ফলে ফকির সন্ন্যাসীরা ইংরেজদের উন্নত, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, রণকৌশল, সামরিক প্রযুক্তি এবং বিশাল সেনাবাহিনীর কাছে প্রাণপণ লড়াই করেও হেরে যায়।

সারসংক্ষেপ

ফকির সন্ন্যাসীদের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম ছিল তাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বনের উপর কোম্পানি হস্তক্ষেপের কারণে তারা তাদের সনাতন অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। এ অবস্থায় নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই তারা ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। এই সংগ্রাম ব্যর্থ হলেও, বিদেশী ইংরেজ শাসকদের নির্যাতনমূলক আচরণের বিরুদ্ধে বাংলার সাধারণ নিঃস্ব মানুষের পক্ষ থেকে এটাই ছিল প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ।

তাৎপর্য

সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বিভিন্ন নেতা নেতৃত্ব দেন। বিদ্রোহীরা প্রথম দিকে ইংরেজ বাহিনীকে পরাজিত করতে সমর্থ হয়৷ কিন্তু ইংরেজদের ব্যবহার্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের কাছে তারা পরাজিত হলে বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। বিদ্রোহটির জনপ্রিয়তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। 1770 খ্রীঃ মন্বন্তরের পরবর্তীকালে সংঘটিত সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ কে দস্যুবৃত্তির সাথে তুলনা করা হয়। সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ ছিল ঔপনিবেশিক শাসনকালে বাংলা তথা ভারতে সংঘটিত প্ৰথম কৃষক বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও পরবর্তীকালের কৃষক বিদ্রোহ গুলিকে পথ দেখিয়েছিল।

Leave a Reply