You are currently viewing মুঘল রাজত্বে কৃষি সংকট ও কৃষক বিদ্রোহ
মুঘল রাজত্বে কৃষিসংকট ও কৃষক বিদ্রোহ

মুঘল রাজত্বে কৃষি সংকট ও কৃষক বিদ্রোহ

আকবরের রাজত্বকালেই কৃষক বিদ্রোহের সংবাদ পাওয়া গেছে। ১৫৬২-তে আগ্রার কাছে সাকেৎ গ্রামে এবং ১৫৭৭-এ আগ্রায় কৃষকরা প্রশাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিল। জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালেও এই একই ছবি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ১৬১০-তে পুনরায় আগ্রায়, ১৬১২-তে সিন্ধু, ১৬১১-তে কনৌজ প্রভৃতি স্থানে কৃষক বিদ্ৰোহ ঘটে। গুজরাট ও রাজস্থানের নানাস্থানেও বিদ্রোহের সংবাদ আছে।

দীর্ঘ প্রায় দুই শতক ধরে ভারতে যে মুঘল সাম্রাজ্য টিকেছিল তার জন্য মুঘল সামরিক শক্তি যতখানি দায়ী ছিল ঠিক ততখানি দায়ী ছিল মুঘল জাগীর ব্যবস্থা। যে-মনসবদার-দের সাহায্য ও সমর্থন মুঘল রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রেখেছিল সেই মনসবদার-দের আর্থিক সংগতিকে পুষ্ট করার জন্য রাষ্ট্র তাদের দিয়েছিল জাগীর। আকবর শেরশাহকৃত রাজস্ব ব্যবস্থাকে অনেকখানি গ্রহণ করলেও বহু অভিনবত্ব তিনি তাতে আরোপ করেন। সেনা পোষণের সঙ্গে জাগীর-কে যুক্ত করায় মনসবদার ও তার জাগীর একীভূত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আকবর মাত্র একবারই অর্থাৎ, ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে বিহার ও বাংলায় বিরোধের মুখে পড়েছিলেন। পরবর্তীকালের সম্রাটরা দু-একবার ছোটোখাটো অসন্তোষের শিকার হলেও ব্যাপক বাধা কোথাও তাঁরা পাননি। । ফলত জাগীর ব্যবস্থা সর্বজনগ্রাহ্য ছিল বলেই ধরে নেওয়া যায়।

ইরফান হাবিবের মতে, সম্রাটের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাই সাম্রাজ্যকে স্থিতিশীল করেছিল কারণ জাগীরদার রা আদৌ স্বাধীন ছিল না বা কী পরিমাণে তারা জাগীর থেকে রাজস্ব আদায় করত তার ওপরও তাদের বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল না। মুঘল রাজস্ব কাঠামো এমনই ছিল যে, তা মনসবদার-দের সেনা পোষণ করার মতো অর্থ জোগান দিতে পারত। কিন্তু সেই রাজস্বের পরিমাণ কখনোই এমন পরিমাণে ছিল না যার দ্বারা কৃষকের জীবনধারণ দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। ড. হাবিবের ভাষায় কৃষক তার জীবনধারণের রসদটুকুর পর উদ্বৃত্ত যা উৎপাদন করত রাষ্ট্র তার সবটুকুই রাজস্ব বাবদে নিয়ে নিত। এজন্যই ফসলের রকম অনুসারে তাদের পৃথক পৃথক বাজারদর অনুযায়ী রাজস্বের দাবি নির্ধারণের প্রক্রিয়া চালু ছিল। সমগ্র সপ্তদশ শতক জুড়ে দেখা যায় যে, ফসলের বাজারদরের আনুপাতিক হারেই কৃষকের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হত।

কিন্তু কৃষির উন্নতির জন্য জাগীরদার আদৌ চিন্তিত ছিল না। সমগ্র মুঘল রাজত্বের হিসাব নিলে দেখা যায় যে, গড়ে একজন জাগীরদার তার নির্দিষ্ট জাগীর-এ তিন বছরের মতো থাকতে পারত। জাগীর ছিল হস্তান্তরযোগ্য। এর ফলে জাগীরের উন্নতি ঘটানোর কোনও তাগিদ জাগীরদার অনুভব করত না। আওরঙ্গজেবের রাজত্বের চিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে ভীমসেন তাঁর নুকশা-ই-দিলখুসা-য় লিখেছেন যে, জাগীরদার কৃষককে কোনোরকম সাহায্য করতে ইচ্ছুক ছিল না। তারা দুর্বৃত্তের মতো কেবল রাজস্ব আদায় করতেই চাইত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা জাগীর ইজারা দিয়ে নগদ এককালীন অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করত। মীরাট-ই-আহমদী-র রচয়িতা আলি মুহম্মদ খান আওরঙ্গজেবের রাজত্বে গুজরাটের ভয়াবহ বিবরণ দিয়েছেন। জাগীরদার-রা বলপূর্বক উৎপাদনের প্রায় আড়াই গুণ উৎপাদন হয় হিসাব কষে কৃষকের কাছ থেকে আনুপাতিক রাজস্ব আদায় করতে চাইত। এ তথ্য সম্ভবত আওরঙ্গজেবের অজানা ছিল না। তিনি জাগীরদার-দের খেয়ালখুশিমতো রাজস্ব আদায় নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু তা কার্যকরী হয়নি। কৃষকের অবস্থা এতই করুণ ছিল যে, রাজস্বের দাবি মেটানোর জন্য তাকে গবাদিপশু থেকে শুরু করে স্ত্রী-পুত্র পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে হত।

কেবলমাত্র জাগীরদার-ই এমন আচরণ করত তা নয়। বদায়ুনীর রচনা উদ্ধৃত করে ড. ইরফান হাবিব লিখেছেন যে, খালিস এলাকায় রূপান্তরিত করে আকবর ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে যখন ক্রোড়ী-দের রাজস্ব আদায়ের জন্য নিযুক্ত করেছিলেন তখন তাদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কৃষকরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। এর ফলে কৃষির ক্ষতি হয়েছিল যথেষ্ট। পরবর্তী সম্রাটের রাজত্বেও চিত্রটা একইরূপ ছিল বলে আগ্রার ডাচ কুঠিয়াল পেলসার্ট লিখেছেন।

আওরঙ্গজেবের রাজত্বে পর্যটক বার্নিয়েরের বিবরণী এদের থেকে ভিন্নকথা বলে না। আদাব-ই-আলমগিরি-কে উদ্ধৃত করে ড. হাবিব লিখেছেন যে, আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের সুবাদার হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পূর্বেই (১৬৫২ খ্রি.) প্রাদেশিক শাসকদের অত্যাচারে কৃষক জমি ছেড়ে পালাত। এই জাতীয় সমস্যা সমগ্র সাম্রাজ্য জুড়েই ছিল। বার্নিয়ের এমনও লিখেছেন যে, বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চাষযোগ্য জমি পতিত পড়ে আছে। একথা সত্য যে, আকবরের রাজত্বে যে-পরিমাণ জমিতে চাষ হত আওরঙ্গজেবের রাজত্বে তার তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণ জমিতে হত। তবে এটা মনে করা ভুল হবে যে, পতিত জমি উদ্ধার করার ফলে এটা সম্ভব হয়েছিল। জমি উদ্ধার কেবলমাত্র ঘটেছিল তরাই অঞ্চলে এবং শায়েস্তা খানের আরাকান জয়ের পর বাংলায়। আবার নতুন এলাকার উন্নতির ফলে পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ছেড়ে কৃষকদের চলে আসার ঘটনাও ঘটত। এর ফলে মোট উৎপাদন আদৌ বৃদ্ধি পেত না।

সমগ্র মুঘল রাজত্বে সরকারের আয় কতখানি বৃদ্ধি পেয়েছিল এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে, যদিও শাহজাহানের রাজত্ব থেকেই খালিস জমির পরিমাণ বৃদ্ধির চেষ্টা হয়। অবশ্য খালিসে মোট জমির পরিমাণ কতখানি বৃদ্ধি পেয়েছিল সে বিষয়ে সন্দেহ থাকলেও ভালো জমিকে যে খালিস-এ রূপান্তরিত করে অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট জমিকে জাগীর হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছিল, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। একইসঙ্গে আর্থিক দিক থেকে সরকারি আয় ঠিক কতখানি বৃদ্ধি পেল সে নিয়েও আপত্তি থাকতে পারে। ড. ইরফান হাবিব দেখিয়েছেন যে, ১৫৯৫-৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে দাক্ষিণাত্য ছাড়া সমগ্র সাম্রাজ্যে মোট জমার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল ৭৮ শতাংশ। একই সময়কালে সোনার মূল্যবৃদ্ধি ঘটে ৫০ শতাংশ এবং তামার ১০০ শতাংশ। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যও তামার সঙ্গে সংগতি রেখে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই পরিসংখ্যানের নিরিখে কখনোই বলা যায় না যে, প্রকৃত অর্থে সরকারের আয় বৃদ্ধি ঘটেছিল।

এই জাতীয় অবস্থার মধ্যে কৃষক তার গ্রাম ও চাষের খেত ছেড়ে পালাত। জমিন্দার দের সর্বদা নির্দেশ দেওয়া হত যে, তারা যেন নতুন নতুন বসতি স্থাপনে উদ্যোগী হয়। তথাপি কৃষকের দুর্গতি কমেনি। মুঘল রাজত্বে নগরগুলির আয়তন এবং সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটায় গ্রাম ছেড়ে যে মানুষ শহরে জীবিকার জন্য ভিড় জমাচ্ছিল, একথা সত্য। এ দৃশ্য বার্নিয়েরও লক্ষ করেছিলেন।

কৃষক বিদ্রোহ

আকবরের রাজত্বকালেই কৃষক বিদ্রোহের সংবাদ পাওয়া গেছে। ১৫৬২-তে আগ্রার কাছে সাকেৎ গ্রামে এবং ১৫৭৭-এ আগ্রায় কৃষকরা প্রশাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিল। আগ্রা ও সন্নিকটবর্তী অঞ্চলগুলিতে জাঠ ও মেওয়াটী কৃষকরা সুলতানি রাজত্বকালেও বহুবার বিদ্রোহ করেছিল। অর্থাৎ, যুগ যুগ ধরে এইসব অঞ্চলে দুর্বিনীত কৃষকরাই বাস করছিল। আকবরের রাজত্বকাল রাজ্য জয় ও প্রশাসনিক কাঠামোর বিস্তারের যুগ হিসেবে বিশেষরকমে চিহ্নিত। ফলে বহু হিন্দু জমিন্দার ও আঞ্চলিক প্রভুরা তাদের গোষ্ঠী তথা বর্ণভুক্ত প্রজাদের নিয়ে মুঘলদের বিরোধিতায় নেমেছিল।

উপরন্তু মুঘল রাজস্ব ব্যবস্থা পাকাপাকিভাবে গঠিত হতে থাকায় বিদ্রোহের প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এ প্রসঙ্গে আমরা কাশ্মীরের প্রসঙ্গ তুলতে পারি। ১৫৮৬-তে কাশ্মীর মুঘলরা জয় করার দিন থেকেই আঞ্চলিক মানুষের অসন্তোষ ধূমায়িত হয় প্রধানত নতুন শাসকদের রাজস্বদাবিকেই কেন্দ্র করে। কাশ্মীরে জমি জরিপ করা সম্ভব হয়নি। গ্রামপিছু যারওয়ার (গাধার পিঠে বোঝাই শস্য) অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা হত। মুঘলরা ক্রমেই খারওয়ার এমন হারে ধার্য করতে থাকে যাদের সঙ্গে উৎপাদনের কোনও সামঞ্জস্য ছিল না। আবার এই রাজস্ব জাগীরদার-রা নগদে আদায় করতে থাকায় রায়তদের সমস্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। কৃষক অসন্তোষ এতই তীব্র আকার নেয় যে, আকবর বাধ্য হয়ে ১৫৯৮-তে নগদে রাজস্ব আদায় পদ্ধতি রদ করে দেন।

জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালেও এই একই ছবি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ১৬১০-তে পুনরায় আগ্রায়, ১৬১২-তে সিন্ধু, ১৬১১-তে কনৌজ প্রভৃতি স্থানে কৃষক বিদ্ৰোহ ঘটে। গুজরাট ও রাজস্থানের নানাস্থানেও বিদ্রোহের সংবাদ আছে। একইরকমভাবে পূর্বে কোচবিহার ও অসমেও বিদ্রোহ সংঘটিত হতে দেখা যায়। কৃষকদের বিদ্রোহী হওয়ার পশ্চাতে অন্য একটি গূঢ় কারণও ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওই কৃষকরা পদাতিক সেনা হিসেবে জমিদারদের বাহিনীতে যুক্ত ছিল। ফলে অস্ত্রচালনায় তাদের দক্ষতাই বিদ্রোহী চেতনাকে আকার দিয়েছিল।

তবে শুধুমাত্র কৃষকরাই বিদ্রোহ করেনি। জমিন্দারদেরও বিদ্রোহ করতে বহুবার দেখা গেছে। যেমন ১৬১৮-তে আগ্রার নিকটস্থ এলাকার জমিন্দার শোভান কুলির বিদ্রোহ, ১৬২০-তে কিসওয়ারের জমিন্দার ও রায়তদের বিদ্রোহ। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল শাহজাহানের রাজত্বকালে বীরসিংহ বুন্দেলার পুত্র জুনর সিংহের বিদ্রোহ।

রাজস্বের অত্যধিক চাপের ফলে যে গ্রামে ডাকাতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছিল, একথা সত্য। তবে অনেক ক্ষেত্রেই গ্রামবাসীরা জোটবদ্ধভাবে কখনো জমিন্দার-দের নেতৃত্বে রাজস্ব দিতে অস্বীকার করত। এইসব গ্রামগুলি চিহ্নিত ছিল জোর তলব এলাকা হিসাবে। সাধারণত যেসব গ্রাম দুর্গম অঞ্চলে, নদী বা জঙ্গলবেষ্টিত, সেইসব গ্রামের বিদ্রোহী হয়ে ওঠার এক স্বাভাবিক প্রবণতা ছিল। আবার যেসব গ্রামবাসী তির-ধনুক বা বর্শা চালাতে পারদর্শী ছিল, সেইসব গ্রামও সহজে সরকারি রাজস্ব দিতে চাইত না। সবক্ষেত্রেই জাতের এক বড়ো ভূমিকা ছিল। ভারতীয় গ্রাম গঠিত ছিল মূলত একই জাতের মানুষকে নিয়ে, যাদের সামগ্রিক স্বার্থ ছিল এক। জাঠ বিদ্রোহ এমনই এক জাতের লড়াই ছিল।

কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে আলোচনা হলেও কোন্ কোন্ সামাজিক বর্ণ ও গোষ্ঠী প্রধানত বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল সে বিষয়ে তথ্য অপ্রতুল। একইসঙ্গে গ্রামীণ জনতার কোন্ অংশ বিদ্রোহে জড়িত ছিল না—সেটাও বিচার করা উচিত। তেমনিভাবে শহরের অধিবাসী বিশেষত, কারিগর ও বণিকশ্রেনীর প্রতিক্রিয়া নিয়েও অনেক কিছু বলার আছে। উত্তর ভারতের বিরাট এলাকায় জমিন্দাররাই বিদ্রোহগুলির নেতৃত্ব দেয় এবং ক্রমবর্ধমান গতিতে সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের সুযোগ তারা নিত। তবে একটা গুরুতর প্রশ্ন আছেই। জমিন্দাররা কি বিদ্রোহ শুরু করত, না সাধারণ কৃষকরা বিদ্রোহী হলে তারা নেতৃত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেয় ?

ড. আলম পূর্বদিকে বেনারস থেকে শুরু করে উত্তর-পশ্চিমে মোরাদাবাদ, উত্তরে বাহরাইচ ও গোরাক্ষপুর থেকে দক্ষিণে বাইশওয়ারা পর্যন্ত এই বিশাল এলাকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। আইন-ই-আকবরীর বিবরণী অনুযায়ী মোরাদাবাদ-বেরিলি অঞ্চলে রাজপুত ও জাঠদের বিভিন্ন গোষ্ঠী জমিন্দারী স্বত্বভোগ করত। অবশ্য কোনও কোনও মহল-এ ব্রাহ্মণ ও মুসলমান ভূস্বামী দেখা গেছে। শাহজাহানের রাজত্বকালে নতুন বিজিত এলাকায় আফগানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বেনারস এলাকাতেও রাজপুতদের প্রাধান্য ছিল যদিও মুসলমান ও ব্রাহ্মণদের দেখা গেছে। গাজীপুর ও জৌনপুর এলাকায় কায়স্থদের ও কিছু ক্ষেত্রে কুরমিদের জমিন্দারীর তথ্য আছে। এদের মধ্যে সকলে মুঘলদের বিরোধী ছিল না।

বিদ্রোহ দমনে অধিকাংশ স্থলে ফৌজদারদের নেতৃত্ব দেখা গেলেও বড়ো বড়ো বিদ্রোহ দমনে সুবাদার স্বয়ং বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হত। অষ্টাদশ শতকে এই সুবাদার-দের অভূতপূর্ব সব ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল। রুস্তম আলি শাহাবাদীর তারিখ-ই-হিন্দী কে উদ্ধৃত করে বলা হয় যে, যথাযথ ক্ষমতা পাচ্ছেন না, এই অভিযোগ জানিয়ে ১৭০৮-এ অযোধ্যার সুবাদার ইস্তফা দিয়েছিলেন। মুহম্মদ শাহর রাজত্বকালে এইসব অঞ্চলের বিদ্রোহ দমনে নিজাম-উল-মুলক, মুহম্মদ আমিন খান ও কামর-উদ-দীন খানের মতো উজীররা কেন্দ্র থেকে গিয়েছিলেন। বহুক্ষেত্রেই বিদ্রোহ দমনে কেন্দ্রীয় বাহিনী ব্যর্থ হয়েছিল। একই জমিন্দার বার বার বিদ্রোহী হয়েছে—এ তথ্যও অপ্রতুল নয়। আওরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষ দিক থেকেই জমিন্দাররা মোরাদাবাদ, বাইশওয়ারা প্রভৃতি অঞ্চলে বার বার বিদ্রোহ করছিল। ১৭০৮-এ গাজীপুরের ফৌজদার জামানিয়ার জমিদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে অনেককে হত্যা করেন। কিন্তু বিদ্রোহ নির্মূল হয়নি। অল্পদিন পরই জমিন্দাররা পুনরায় জোটবদ্ধ হয় এবং বিহারের উম্মাই নিয়ারা এসে তাদের সঙ্গে মিলিতভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বিদ্রোহীরা গাজীপুর শহর পর্যন্ত বিপর্যস্ত করে দেয়। জৌনপুরের রাজপুত জমিন্দারদের সঙ্গে আফগানরাও যুক্ত হয়েছিল।

অবশ্য জাতের এই বন্ধন ছাড়াও ধর্মীয় এক বন্ধন ভারতীয় কৃষককে বা গ্রামকে এক নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করতে পেরেছিল। ড. ইরফান হাবিব এই বন্ধনের এক বিবরণী দিয়েছেন। সুলতানি যুগে যে-ভক্তি আন্দোলনের প্রসার ঘটে তার ফলে হিন্দুধর্মের সনাতনি প্রথা প্রকরণে আমূল পরিবর্তন ঘটে। সাধারণ মানুষ যারা ছিল তথাকথিত ‘নিচুজাতের’ তারা এক মুক্তির স্বাদ লাভ করল যা জাতের বন্ধনকে ভেঙে দেয়। কবীর ছিলেন একজন জোলা, রবিদাস ছিলেন ডোম, দাদু সাধারণ তাঁতি, হরিদাস একজন ক্রীতদাস। এঁরা প্রত্যেকেই মানুষে মানুষে সম্প্রীতির কথা বলতেন যেখানে হিংসার বিন্দুমাত্র স্থান ছিল না। কিন্তু এই ধর্মীয় ভাবনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে গড়ে উঠল এক অভিনব স্বাজাত্যপ্রেম, যা সতনামি ও শিখদের বিদ্রোহের মাধ্যমে প্রকট হয়েছিল।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষক বিদ্রোহের প্রধান কারণই ছিল অর্থনীতি। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক বা সামরিকও ছিল। তবে ধর্মীয় প্রভাবকে অস্বীকার করা চলে না। এ প্রসঙ্গে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী এলাকাগুলির উদাহরণ দেওয়া চলে। আকবরের রাজত্বকালে এই উপজাতি প্রধান এলাকায় বায়াজিদ নামক এক অশ্ব-ব্যবসায়ী ইসলামের নতুন ব্যাখ্যা দিতে থাকেন এবং কৃষিজীবীদের মধ্যে নিজের মত প্রকাশ করতে থাকেন। আকবর রাষ্ট্রশাসনে গোঁড়া ধর্মীয় আচরণ পরিহারের পক্ষে ছিলেন যা অনেক কট্টরপন্থীর মনঃপূত ছিল না। বায়াজিদ ইসলামের নানা রীতিনীতির বিপক্ষে ছিলেন যদিও সম্রাটের মানসিকতার সঙ্গে তাঁর মিল ছিল না। তাঁর ধর্মীয় আন্দোলনকে রোশনিয়া আন্দোলন বলা হল। বায়াজিদের জনপ্রিয়তা ছিল যথেষ্ট। তিনি একযোগে কাবুলের শাসনকর্তা মীর্জা হাকিমের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। তাঁকে দমন করতে মান সিংহকে প্রেরণ করা হলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। বীরবলও সেনা অভিযানে প্রাণ দেন। বহুরক্তের বিনিময়ে আকবর এই অঞ্চলকে বশীভূত করেছিলেন। এই জাতীয় বিদ্রোহের দুটি চরিত্রের কথা ড. ইরফান হাবিব উল্লেখ করেছেন। জমিন্দার-এর নেতৃত্বে কৃষক বিদ্রোহ এবং বিদ্রোহের সুযোগে বিদ্রোহী জমিন্দার-এর উত্থান।

নিজেদের গোষ্ঠীভুক্ত মানুষরাই ছিল জমিন্দারদের শক্তির উৎস তথাপি কোনও কোনও ক্ষেত্রে সামাজিক পরিস্থিতির হেরফেরে সমন্বয়ের অভাব দেখা দিত। জমিন্দাররা বর্ণ, গোষ্ঠী ও অঞ্চলভেদে একে অন্যের থেকে পৃথক ছিল এবং সেকারণে তারা প্রতিনিয়ত নিজেদের মধ্যে লড়াই করত। সেকারণে প্রত্যেক জমিন্দারই বাইরের কোনও শক্তির সাহায্য লাভে উন্মুখ থাকত। যেহেতু মুঘল শাসন তখন ক্ষয়িষ্ণু সেইহেতু জমিদারদের মধ্যে সংঘাত ছিল প্রতিদিনের ঘটনা। এই সংঘাতের ফলে গ্রামীণ জনতাই সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হত। যেমন ১৭১১-তে হাসানপুরের আফগান জমিন্দাররা প্রতিবেশী অঞ্চল বাদাউন আক্রমণ করে তার বিপুল ক্ষতি করে। রাজপুরের রাজপুত জমিন্দারের আক্রমণে বেরিলি ও মোরাদাবাদের বিরাট এলাকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। জমিদারদের অত্যাচারের ফলে কৃষকরা অধিক পরিমাণে রাজস্ব জমা করতে বাধ্য হত। বাইশ ওয়ারার জমিন্দারদের এ প্রসঙ্গে যথেষ্ট বদনাম ছিল। ১৭১৫-তে বেনারসের বিরাট এলাকায় কৃষকরা জমিন্দারদের আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়। এমন ঘটনা চুনার ও গাজীপুরেও ঘটতে দেখা গেছে।

অর্থাৎ, কৃষক বিদ্রোহের পিছনে জমিন্দার-দের ভূমিকা অস্বীকার করার নয়। জমিন্দার দের সঙ্গে কৃষক ও গ্রামীণ জনতার আত্মিক যোগ ছিল। তারা সরকারি প্রতিনিধি নয় বা তাদের অস্তিত্ব সরকারি বিধির কারণে নির্দিষ্ট ছিল না। জমিন্দার-দের অধীনে সর্বদাই এক শ্রেণির সশস্ত্র পাইক থাকত যারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে জাতের দিক থেকে ছিল একই শ্রেণির। জমিন্দার-এর সঙ্গে সরকার বা সরকারি প্রতিনিধি যেমন, জাগীরদার-দের নিয়ত ঝগড়া লেগে থাকত রাজস্বের বখরা নিয়ে। জমিন্দার রাজস্ব আদায়ের জন্য নিযুক্ত ছিল। কিন্তু মুঘল রাষ্ট্রের চড়া হারে রাজস্বের দাবি মেটাতে গিয়ে বহুক্ষেত্রেই তার নিজের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হত। এমনই কারণে সংঘর্ষের পথ প্রশস্ত হত। উভয়ের হাতেই সশস্ত্র অনুচর থাকায় রক্তপাত ছিল স্বাভাবিক চিত্র।

সরকারি স্তরে এটা ধরেই নেওয়া হত যে, গ্রামে অশান্তির মূল কারণ হচ্ছে জমিন্দার শ্রেণী যারা কোনোভাবেই রাজস্ব দিতে চায় না এবং সরকারি দমন-পীড়নই তাদের একমাত্র উপায়। ১৬৯৫ থেকে ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলায় ছিটা-বরদার জমিন্দার শোভা সিংহের বিদ্রোহ ছিল এমনই এক ঘটনা। শোভা সিংহ বর্ধমানের সরকার অনুগত জমিন্দার-কে হত্যা করেন এবং ওইরকম বেশ কিছু জমিন্দার-কে বিতাড়িত করেন। তাঁর বিদ্রোহের পিছনে যে-জনসমর্থন ছিল তা এটাই প্রমাণ করে যে, গ্রামে গ্রামে জমিন্দার-দের প্রভাব কত গভীরভাবে প্রোথিত।

একই ধরনের চিত্র সপ্তদশ শতকের গুজরাটে দেখা যায়। মীরাট-ই আহমদী-র বর্ণনা অনুযায়ী গুজরাটের সুবাদার আজম খানের (১৬৩২-৪২ খ্রি.) অত্যাচারে কৃষকরা গ্রাম থেকে পালিয়ে দূর দূর অঞ্চলের জমিন্দার-দের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। লাহোরীর বাদশাহনামা-কে উদ্ধৃত করে ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে মালবের ঘটনা উল্লেখ করেছেন ড. ইরফান হাবিব। সেখানে গিন্নুরের জমিন্দার-এর বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, কারণ তারই প্রশ্রয়ে স্থানীয় কৃষকরা রাজস্ব জমা দিতে চাইছিল না। আবার ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় কোচবিহার জয় করার পর মুঘল শাসনে যে-রাজস্ব ব্যবস্থা সেখানে চালু হয়েছিল তা কোনোভাবেই প্রজারা মানতে চাইছিল না। স্থানীয় মানুষ মুঘল কর্মচারী এমনকি সেনাদেরও উৎখাত করে দেয়।

আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে গুজরাটে ১৬৮০ থেকে অন্তত পাঁচ বছর কুবি, কোলি কৃষক ও খোজা ব্যবসায়ীরা মিলিতভাবে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফরাসি পর্যটক ফ্রাঁসোয়া মার্তা বিদ্রোহীদের মাবিয়া ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত বলেছেন। অর্থাৎ, এখানেও এক ধর্মীয় মোড়ক ছিল। ইমামউদ্দীন নামক এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির শিষ্য ছিল কুবি কৃষকরা। ১৬৮০ থেকে গুজরাটে খাদ্যসংকট দেখা দিলে গ্রামগুলিতে যেমন সমস্যা দেখা দেয় তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যে। সরকার কিন্তু কর হ্রাসে ইচ্ছুক ছিল না, ফলে প্রতিরোধ। একইভাবে আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে বর্তমান রায়বেরিলির নিকটবর্তী অঞ্চলে ঘটে কুর্মি কৃষকদের বিদ্রোহ। দাসীরাম নামক এক স্বঘোষিত পীরের অনুগামীরাই ছিল প্রধান।

তবে সব থেকে বড়ো বিদ্রোহ ঘটায় সৎনামী কৃষকরা। এক্ষেত্রেও ধর্মীয়ভাব ছিল প্রবল। বীরভান নামক এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ষোড়শ শতকের শেষ কি সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে দিল্লির নিকটবর্তী অঞ্চলে তাঁর ধর্মমত প্রচার করেন। মাসির-ই-আলমগীরী-তে এদের নিচুবর্ণের কৃষক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। শুধুমাত্র কৃষকই নয়, চামার, ছুতোর, মেথর প্রভৃতি নানা জাতের মধ্যে বীরভানের ধর্মমত জনপ্রিয় হয় ও তারা এক প্রতাপশালী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। মজার কথা ছিল সরকারি মুসলমান প্রতিবেদক যেমন এদের ঘৃণা করতেন তেমনি উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণরাও। আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে ১৬৭২-৭৩-এ বর্তমান হরিয়ানার নানা অংশে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমান পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ জুড়ে যে-জাঠ কৃষকদের বাস ছিল, তারা সুযোগ পেলেই বিদ্রোহী হত। সাধারণভাবে জমিন্দাররা রাজস্ব দিতে ইচ্ছুক ছিল না এবং সরকারি দলিলে অনেক গ্রামকেই জোর তলব বলা হয়েছিল। ১৬৬৯ থেকে সরকারি বিধি-নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চলতে থাকে এবং কোনোমতেই তা দমন করা যাচ্ছিল না। প্রথমে চন্দর খান এবং তারপর রাজারাম জাঠ বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দেন। রাজারাম সরকারি সেনাদের হাতে নিহত হন ও নতুন নেতা হন চূড়ামন। তিনি ভরতপুরের জঙ্গলে আস্তানা স্থাপন করে সরকারি কর্মচারীদের নিজ এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেন ও নিজেই রাজস্ব আদায় করতে থাকেন। পাশাপাশি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ওপরও নানারকম আর্থিক উৎপীড়ন চালাতে থাকেন। তাঁকে কোনোমতেই দমন করা সম্ভব হয়নি। ফারুকশিয়র তাঁকেই সরকারি রাজস্ব আদায়ের ভার দেন।

জমিন্দার ও কৃষকের সম্মিলিত প্রতিরোধকে দমন করার জন্য মুঘল গোলন্দাজ বাহিনী ছিল প্রধান ভরসা। কিন্তু আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে জমিন্দাররাও গোলা-বন্দুক সংগ্রহ এবং তৈরি করতে থাকে। ফলে দীর্ঘকালের মুঘল শক্তি এক বিরাট বাধার মুখে পড়ে। গৃহহীন এবং অত্যাচারিত কৃষকদের নিয়েই গঠিত হল সেই বন্দুকবাজ সেনাদল, যারা প্রতিনিয়ত চোরাগোপ্তা আক্রমণে মুঘল অশ্বারোহীদের বিপদে ফেলত।

মুঘল প্রশাসনও জমিন্দারদের বর্ণ, গোষ্ঠী প্রভৃতির বিষয়ে ভালোই অবগত ছিল এবং প্রয়োজনমতো সেসব নিয়ে রাজনীতিও করত। যেমন অযোধ্যায় রাজপুত জমিন্দারদের প্রভাব হ্রাস করতে তারা অন্য বর্ণের ব্যক্তিদের জমিন্দারি ক্রয়ে প্ররোচিত করে। আবার উনাও পরগনায় বাইশ গোষ্ঠীকে দমন করতে তারা সৈয়দ জমিন্দারদের পৃষ্ঠপোষকতা করত। কিছু অঞ্চলে প্রশাসন তথা স্থানীয় চৌধুরীরা জোটবদ্ধ হয়ে রাজপুত জমিন্দার-দের অন্য বর্ণভূক্তদের কাছে জমিন্দারি বিক্রি করতেও বাধ্য করত। বেনারসে ব্রাহ্মণ ও ভূমিহার জমিন্দাররা যৌথভাবে বিদ্রোহী রাজপুত জমিন্দার দের মোকাবিলা করে। মুঘল প্রশাসনের প্রশ্রয়েই অষ্টাদশ শতকে বেনারস এলাকায় ভূমিহার রাজপরিবারের উত্থান ঘটে।

রাজপুতরা ছিল বিশেষ রকমে শক্তিশালী। তাদের দমন করাও ছিল যথেষ্ট কঠিন। অন্য বর্ণভুক্ত বা মুসলমান ভূস্বামীদের প্রশাসনিক সাহায্য দেওয়া হলেও যুদ্ধক্ষেত্রে তা সফল হয়নি। বহুক্ষেত্রে রাজপুত জমিন্দাররা সরকারি রাজস্বকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের খুশীমতো ‘জমা’ নির্ধারণ করে সেটাই রাজকোষে জমা দিত। পরিস্থিতির চাপে পড়ে প্রশাসন ১৭৩৫-এ বেনারসের মালওয়া পরগনাতে স্থানীয় রাজপুত নেতা লাল শাহীকে কার্যত স্বায়ত্তশাসনই প্রদান করেছিল। এই লাল শাহীর পুত্র বলবন্ত সিংহ বেনারসের প্রথম রাজা হয়েছিলেন।

বর্তমান উত্তরপ্রদেশের এইসব এলাকায় কৃষির সমৃদ্ধির কারণে বিদ্রোহের প্রবণতাও ছিল বেশি। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকেও বিহার ও উত্তরপ্রদেশে বানজারা বণিকদের নিয়মিত আনাগোনা ছিল। সৈয়দ মুজাহার হুগেইন ক্রোই তাঁর তারিখ-ই-বনারস গ্রন্থে লিখেছেন যে, ১৭১৫-তে রাজপুর ও মোরাদাবাদের জমিন্দাররা বানজারা বণিকদের কাছ থেকে চার লক্ষ টাকা মূল্যের সম্পদ লুঠ করে নিয়েছিল। আজমগড়, ভাদৌ ও মির্জাপুরের মতো বৃহদাকৃতির বাজারের উপস্থিতি প্রমাণ করে স্থানীয় অধিবাসীদের আর্থিক স্বাচ্ছলা। এক হিসাবে বলতে গেলে বেনারস শহরের শ্রীবৃদ্ধির পশ্চাতে অন্যতম কারণই ছিল দূরপাল্লার বাণিজ্য।

ড. আলম নিশ্চিত যে, বহু অঞ্চলে আর্থিক দুর্গতি বা কৃষির অবক্ষয়ের কারণে জমিন্দাররা বিদ্রোহ করেনি। বরং তাদের আর্থিক সমৃদ্ধির কারণে তারা সামরিক দিক হতে শক্তিশালী হয়ে ওঠে ও বিদ্রোহ করে। অন্যদিকে মুঘল রাষ্ট্রশক্তির অবক্ষয় ও রাজস্ব আদায়ে নিয়ন্ত্রণের অভাব প্রশাসনকে দুর্বল করে তোলে। তাই বহু অঞ্চলে বিদ্রোহ ক্ষুব্ধ ও বঞ্চিত কৃষকরা করেনি। আবার প্রভাবশালী জমিন্দার গোষ্ঠী রাজপুতদের মোকাবিলা করতে প্রশাসনের পক্ষেই ভূমিহার, সৈয়দ ও আফগানদের সাহায্য করার কারণে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থেকে রক্তাক্ত যুদ্ধ পর্যন্ত ঘটত। সেগুলিকেও বিদ্রোহ হিসেবে বর্ণনার প্রবণতা আছে কারণ ওই গোলযোগে সরকারি আদায় বন্ধ হয়ে যেত।

গ্রামাঞ্চলে অশান্তির মূল কারণ হিসেবে সরকারি রাজস্বকেই চিহ্নিত করা যেতে পারে এবং এটা মনে করা ভুল যে, আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালেই এই জাতীয় সমস্যার উৎপত্তি।

Leave a Reply