You are currently viewing Akbar Rajput Policy | আকবরের রাজপুত নীতি বিস্তারিত বর্ণনা
Akbar Rajput Policy

Akbar Rajput Policy | আকবরের রাজপুত নীতি বিস্তারিত বর্ণনা

সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতির কারণ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বর্ণনা করো। 

বিস্তারিত বর্ণনা।

রাজপুত নীতির ফলাফল।

সার-সংক্ষেপ

মুঘলদের ভারতবর্ষে রাজ্য স্থাপনকালীন সময়ে এদেশের অন্যতম প্রধান শক্তি ছিল রাজপুত জাতি। জাতিগতভাবে রাজপুতরা ছিল হিন্দু। তারা বীর ও স্বজাত্যবোধে সচেতন যোদ্ধা হিসেবে খ্যাত ছিল। সম্রাট আকবর রাজ্যের স্থায়িত্ব ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে একটি যৌক্তিক রাজপুত নীতি গ্রহণ করেন। নিম্নে সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতি আলোচনা করা হলো। সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতিকে দুভাগে ভাগ করা যায়। যেমনঃ ১. মিলনার নীতি এবং ২. যুদ্ধংদেহী নীতি।

সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতির কারণ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বর্ণনা করো। 

আকবর রাজপুতদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন, তাদেরকে উচ্চ পদে নিয়োগ, জিযিয়া ও তীর্থ কর রহিতকরণ, এবং হিন্দু সংস্কৃতি পৃষ্ঠপোষকতা করে মিত্রতা স্থাপন করেন। আকবর স্বয়ং অম্বররাজ বিহারীমলের, বিকানীর ও জয় সিলমিরের রাজপুত কুমারীকে বিয়ে করেন। তিনি ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র সেলিমের সাথে জয়পুরের রাজা ভগবান দাসের কন্যার বিয়ে দেন। রাজার টোডরমল, রাজা বিহারী মল, ভগবান দাস এবং মানসিংহকে উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত করেন। তিনি জিযিয়া ও তীর্থযাত্রীদের কর রহিত করেন। তিনি হিন্দু কবি পণ্ডিত ও চিত্রশিল্পীদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সম্রাট আকবর হিন্দু সমাজের বাল্যবিবাহ নিষিন্ধ করেছিলেন। বিধবাদের পুনর্বিবাহে উৎসাহদান ও সতীদাহ প্রথা নিবারণ করার চেষ্টা করেছিলেন।

রাজপুতদের প্রতি মিলনাঝ নীতি গ্রহণ করলেও আকবর তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও বিরোধিতা সহ্য করেননি। তিনি চিতোর রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন। রনথম্ভোর, যোধপুর, বিকানী, জয় সালমি প্রভৃতি রাজ্য সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। রানা প্রতাপসিংহ তাঁর বশ্যতা স্বীকার না করায় হলদিঘাটের যুদ্ধে তাঁকে পরাজিত করেন। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতাপ সিংহের পুত্র অমরসিংহ পরাজিত হলে রাজপুত যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

বিস্তারিত বর্ণনা।

আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সময়ে ভারতীয় রাজশক্তির মধ্যে রাজপুতদের শক্তি ছিল সর্বাপেক্ষা বেশি। আবুল ফজলের বিবরণী অনুসারে তাদের সেনা ও অশ্বের সংখ্যা ছিল বিস্ময়কর। আকবর এই পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুভব করেন। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় এই জাতীয় শক্তিশালী জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। ভারতে তিনিই প্রথম শাসক যিনি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা ত্যাগ করে বাস্তববোধের দ্বারা এমনভাবে চালিত হন। তাঁর কৃত ব্যবস্থার ফলে মুঘল রাষ্ট্র যথেষ্ট নিরাপদ হয়েছিল। তিনি এক হাতে বিবাহের কূটনীতি এবং অন্য হাতে তরবারি চালনার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। আকবরের রাজপুতনীতি বিশ্লেষণ করলে তাঁর কূটনীতির জ্ঞানকে অবশ্যই প্রশংসা করতে হয়।

তিনি যে শুধুমাত্র রাজন্যবর্গকে মনসব প্রদানের সিদ্ধান্ত নিলেন, তা নয়। তিনি অধস্তন সর্দার-দেরও মনসব প্রদান করে সমগ্র রাজপুতানায় মুঘল শক্তিকে স্থায়ী করার ব্যবস্থা করেন। তাঁদের ব্যক্তিগত রাজ্য তথা ভূসম্পত্তি আকবর কখনো স্পর্শ করেননি।

এভাবেই সৃষ্টি হল ওয়াতন জাগীর। সম্পত্তির বংশগত নিরাপত্তা লাভ করে রাজপুতরা মুঘলদের প্রতি বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে। আকবরের রাজপুতনীতির কাল বিভাজন তিনটি স্তরে ভাগ করা যেতে পারে – ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে গুজরাট অভিযান পর্যন্ত প্রথম পর্ব, ১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে মুঘলদের কাশ্মীর এবং উত্তর-পশ্চিম অভিযানের প্রস্তুতির সঙ্গে পাঞ্জাবের ভেরায় রাজা ভগবত্তদাস এবং মান সিংহের যোগদান পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্ব এবং অন্তিম পর্ব হল আকবরের রাজত্বের অবশিষ্ট বছরগুলি পর্যন্ত। সুলতানি রাজত্বে রাজপুতদের প্রতি কেন্দ্রীয় শক্তির মনোভাব বন্ধুত্বের ছিল না।

সুলতানরা সর্বদা স্থানীয় রাজন্যবর্গকে উৎখাত করে কেন্দ্রের কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করার নীতি অবলম্বন করতেন। আলাউদ্দীন খলজী অবশ্য কিছুটা ব্যতিক্রমী ছিলেন। দেবগিরির রাজাকে পরাস্ত করেও তাঁকে রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং বন্ধুত্বের পুরস্কার হিসেবে গুজরাটের নভসিরি জেলাও দেওয়া হয়। কিন্তু এই রকমের আচরণ পরবর্তীকালের সুলতানরা করেননি। লোদী রাজত্বে দোয়াব অঞ্চলে রাজপুতদের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করার ইতিহাস আছে এবং আফগান-রাজপুত সম্পর্ক মুঘলদেরও কিছুটা বেগ দিয়েছিল।

শের শাহের কাছে পরাস্ত হয়ে হুমায়ুন পারস্যে পলায়ন করেছিলেন। দীর্ঘদিন পর তিনি এদেশে ফিরে এসে স্থানীয় রাজন্যবর্গের গুরুত্ব অনুভব করতে পারেন এবং তাদের সঙ্গে স্থায়ী সম্পর্ক স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। পারস্যে থাকাকালীন হুমায়ুন এটা সম্যক বুঝতে পেরেছিলেন যে, স্থানীয় স্তরে ক্ষমতার ভিত্তি না থাকার ফলেই তাঁর এই দুর্গতি ঘটেছে।

তিনি রাজপুতদের স্বপক্ষে আনার পরিকল্পনা করেন রাজপুত-আফগান সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। তবে তাঁর পক্ষে সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার মতো সময় ছিল না। এইরকম পরিস্থিতিতে বৈরাম খান নিজের আধিপত্য নিরঙ্কুশ করার উদ্দেশ্যে চুঘতাই অভিজাতদের ক্ষমতা দমন করে রাজপুতদের কিয়দংশে ক্ষমতার ভাগ দিতে শুরু করেন। রাজপুতরা মুঘলদের কাছে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণও করেছিল।

১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে এক মত্ত হাতি যখন আকবরকে নিজের পিঠ থেকে ফেলে দিতে চেষ্টা করে তখন অম্বরের রাজা ভারামল ও তাঁর অনুচররা নিজেদের প্রাণ তুচ্ছ করে আকবরকে বাঁচিয়েছিলেন। আকবর সেই সময় থেকে রাজপুতদের প্রতি বিশেষভাবে অনুরক্ত হয়ে ওঠেন।

রাজপুতানায় মুঘলদের সম্পর্ক বিস্তারের কাহিনী লিখতে গিয়ে আবুল ফজল রাজপুতদের মূলত দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন–(১) স্থানীয় জমিন্দার, বুমিয়ান, মর্জাবান ইত্যাদি এবং (২) তাদের প্রজা

যেমন রায়ত ও মরদুম। আকবর পূর্বেকার যাবতীয় ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটান। রাজপুতানায় তিনি স্থানীয় রাজন্যবর্গকে হয় পরাজিত নয় অধীনতা স্বীকারে বাধ্য করেন এবং তারপর তাদের সাম্রাজ্যের অংশীদার করেন। এমনকী, মনসব-এর ক্ষেত্রেও তিনি উদারভাবে রাজপুতদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

রাজপুতানায় আকবর তাঁর বিবাহের কূটনীতি চালু করেন ১৫৬১-৬২ খ্রিস্টাব্দে। 

সে সময়ে মেওয়াটের মুঘল হাকিমের হাতে অম্বর রাজ ভারামল নানাভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আকবরের শরণাপন্ন হন। আকবর আজমিড়ে শেখ মৈনুদ্দিন চিস্তির দরগায় তীর্থ করে রাজধানীতে ফিরে আসছিলেন। ভারামলকে রক্ষার শর্ত হিসাবে আকবর তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে এসে বশ্যতা স্বীকার ও ভারামলের এক কন্যার পাণি দাবি করেন।

ভারামল তাঁর শর্ত পূরণ করলে আকবর অম্বরকে যথেষ্ট মর্যাদা প্রদর্শন করেন এবং ভারামলের কন্যা বাঈ হরকাকে বিবাহ করে দীর্ঘকালীন মেয়াদের বিবাহের কূটনীতি শুরু করেন।

কিন্তু ভারামলের কন্যার পাণিগ্রহণের পরবর্তী বেশ কয়েক বছরে আকবরের সঙ্গে রাজপুতদের বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠতে দেখা যায়নি। তবে যেসব রাজপুত রাজ্য যেমন, পান্না, গড় কাটাঙ্গা (গণ্ডোয়ানা), ভাটা-খোরা মুঘল সম্রাটের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল—সেগুলির সঙ্গে আকবর মৈত্রীপূর্ণ ব্যবহার করেছিলেন।

১৫৬২ থেকে ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আকবর বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেন। যুদ্ধে পরাজিত রাজ্যের নারী ও শিশুদের বাধ্যতামূলকভাবে যে দাসে পরিণত করার প্রথা ছিল তিনি তা তুলে দেন। হিন্দুদের তীর্থকর লোপ করেন এবং ১৫৬৪-তে প্রথম দফায় জিজিয়া প্রত্যাহার করেন বলে দাবি করা হয়। এসবই সামগ্রিকভাবে রাজপুতদের খুশি করে।

পাশাপাশি আকবরের দৃষ্টি সমৃদ্ধ রাজ্য গুজরাটের প্রতিও ছিল। দিল্লি বা আগ্রা থেকে গুজরাটকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ভৌগোলিক দিক থেকে রাজপুতানাকে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল জরুরি। ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দীন খলজীও একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেছিলেন। কিন্তু অম্বরের ভারামল যেভাবে মুঘলদের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলেন সেভাবে প্রতিটি রাজ্য করতে আগ্রহী ছিল না। যারা ছিল না, তাদের মধ্যে অন্যতম রাজ্যটি হল মেবার। গুজরাটের পথে মেবার ছিল অসীম শক্তিধর রাজ্য যার সামাজিক মর্যাদাও ছিল আকাশচুম্বী।

১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে খানুয়ার যুদ্ধে বাবর মেবারের রানা সংগ্রাম সিংহকে পরাস্ত করলেও তাঁর রাজ্য দখল করতে পারেননি। তবে মেবারের দুর্ভাগ্য তখন ঘনিয়ে আসছিল। গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে মেবারের রাজধানী চিতোর আক্রমণ করেন। রানা বিক্রমাদিত্য কোনো মতে শাস্তি আনলেও ১৫৩৫-এর আক্রমণে চিতোর গুজরাটের দখলে চলে যায়। অল্পদিনের মধ্যে বিক্রমাদিত্য চিতোর উদ্ধার করলেও মেবারের পূর্বেকার শৌর্য তখন অনেকটা ম্লান হয়ে গেছে। এই অবসরে মাড়ওয়ারের রাঠোর রাজা মালদেবের উত্থানের ফলেও মেবার বহুলাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে রানা উদয় সিংহ চিতোরের সিংহাসনে বসেন এবং ১৫৪০-এর মধ্যে তিনি অন্যান্য রাজপুত রাজাদের ওপর নিজের প্রভুত্ব কিয়দংশে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। আবুল ফজল মেবারের শক্তির উৎস হিসাবে চিতোর, মণ্ডলগড় এবং কুম্ভলগড় কেল্লার উল্লেখ করেছেন। ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই পার্শ্ববর্তী হাড়া রাজপুত রাজা রাও সুর্জন এবং শিরোহীর রাজা রাইমান উদয় সিংহের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন।

মেবারের শক্তিবৃদ্ধি অবশ্যই অম্বরের অজানা ছিল না। মালবের পলাতক শাসক বাজবাহাদুরকে ১৫৬২-৬৩ খ্রিস্টাব্দে আশ্রয় দিয়ে উদয় সিংহ আকবরের বিরাগভাজন হন। মূলত এই কারণেই আকবর চিতোর আক্রমণের পরিকল্পনা করেন এবং ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে নিজে সেনা নিয়ে মেবারের দিকে অগ্রসর হন। কয়েক মাসের মধ্যেই মণ্ডলগড় এবং চিতোরগড় মুঘলদের হাতে চলে যাওয়ায় মেবারের শক্তি অনেকাংশেই হ্রাস পায়। রানা কুম্ভলগড়ে আশ্রয় নেন এবং নতুন রাজধানী উদয়পুর প্রতিষ্ঠা করেন।

এখান থেকে রানা মুঘলদের বিরুদ্ধে নতুন করে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করেন এবং কোনোভাবেই আকবরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে রাজি হন না।

গুজরাট বিজয় সমাধা করে আকবর নতুন করে মেবারের দিকে নজর দেন। ইতিমধ্যে উদয় সিংহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রতাপ রাজধানী চিতোর ফিরে পাওয়ার জন্য সেনা ও রসদ সংগ্রহ করতে শুরু করেন। ১৫৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দে আকবর অম্বরের ভগবন্তদাস ও তাঁর পুত্র মান সিংহের নেতৃত্বে দুটি প্রতিনিধিদল মেবারে পাঠান প্রতাপকে বশ্যতা স্বীকার করানোর জন্য।

প্রতাপ নিজের পুত্র অমর সিংহকে যথাযথ পেশকাশ (উপঢৌকন) দিয়ে মুঘল দরবারে পাঠান। কিন্তু আকবর দরবারে প্রতাপের ব্যক্তিগত উপস্থিতি দাবি করেন। প্রতাপ আকবরের দরবারে যেতে অস্বীকার করেন। অপরদিকে আকবরও ছিলেন অনড়। অতঃপর ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা মান সিংহের নেতৃত্বে মুঘল বাহিনীর হাতে হলদিঘাটের যুদ্ধে প্রতাপ পরাজিত হন।

আকবর কিন্তু প্রতাপকে আক্ষরিক অর্থে অধীনতা স্বীকারে বাধ্য করতে পারেননি। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের পর মুঘলরা কুম্ভলমের, গোগুণ্ডা এবং উদয়পুরে সেনা-ছাউনি স্থাপন করে প্রতাপ ও তাঁর পুত্রকে কেবলমাত্র মেবারের দক্ষিণ-পশ্চিমের পার্বত্য এলাকায় নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য করেছিল।

মেবার অভিযানকালে আকবর কূটনীতিরও আশ্রয় নেন। তিনি প্রতাপের দুই ভাই, জগমাল এবং শক্তি সিংহকে এবং মেবারের সামন্ত, রাজপুরার রাইদুর্গা শিশোদিয়কে নিজপক্ষে নিয়ে আসেন। এঁদের উচ্চ মনসব এবং জাগীর দেওয়া হয়।

মেবারের উত্তর-পূর্বে ছিল কাছোয়া রাজপুতদের রাজ্য, যার রাজধানী ছিল অম্বর। অম্বরের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে আকবর রাজপুতানায় মুঘল রাজনীতির এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন। তিনি অম্বরের রাজাকে বংশানুক্রমিকভাবে উচ্চ মনসব দেওয়ার প্রথা চালু করেন যা আওরঙ্গজেব পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। প্রথা ভেঙে তিনি রাজা মান সিংহকে ১০ হাজারী মনসব পদ প্রদান করেছিলেন। শুধুমাত্র রাজপরিবারকেই নয়, কাছোয়াদের অধীন অন্যান্য সামন্তদেরও মনসব দেওয়া হয়। আকবর মনসব-এর বেতন বাবদ যে জাগীর দিতেন তা ছিল হস্তান্তরিত এবং এই হস্তান্তরে গড়ে ২% বছরের মাথায় ঘটত। কিন্তু রাজপুতানায় যেসব রাজা ও সামন্ত মুঘলদের মনসব গ্রহণ করল তাদের নিজ নিজ রাজ্যকেই জাগীর হিসাবে চিহ্নিত করা হল। এগুলি ছিল বংশানুক্রমিক ওয়াতন জাগীর।

১৫৮৬-৮৭ খ্রিস্টাব্দে কাছোয়া পরিবারের চার সদস্য জগন্নাথ, রাজা অক্ষরণ, রাজা ভগবন্তদাস এবং মান সিংহ একইসঙ্গে যথাক্রমে সুবা আজমিড়, আগ্রা, লাহোর এবং কাবুলের আমীরের পদ লাভ করেছিলেন। বহুক্ষেত্রে নিজস্ব ওয়াতন থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হত তা অপেক্ষা মনসব পদের বেতন ছিল বেশি। সেই অতিরিক্ত বেতন মিটিয়ে দেওয়া হত অন্যত্র জাগীর দানের মাধ্যমে। ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে মান সিংহকে মালবে এবং পুনরায় ১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে জাগীর দেওয়া হয়। তাঁর মতো অনেকেই অন্যান্য সুবায় জাগীর লাভ করতে থাকেন। শুধুমাত্র রাজাই নন, তাঁর অনুচররাও নিজ নিজ পদ অনুসারে মনসব এবং জাগীর লাভ করেছিল।

দেখা যায় যে মৌসুমী কৃষকদের বড়ো অংশই কোনো-না-কোনো রাজার সেনাদলের সদস্য এবং সেই সূত্রে বছরের কোনও একটা সময়ে মুঘল অভিযানের অংশীদার। আকবরের রাজত্বে তো বটেই, তাঁর উত্তরাধিকারীদের রাজত্বেও মুঘল বাহিনীর সদস্য হওয়া যথেষ্ট লাভদায়ক ছিল। যুদ্ধ জয়ের পর লুঠের এক-পঞ্চমাংশ সেনারা লাভ করত। বলা যেতে পারে যে, মরুময় রাজপুতানার অর্থনৈতিক গতি পরিবর্তিত হতে থাকে এর ফলেই। কাছোয়া পরিবারের প্রতি আকবরের দুর্বলতা বৃদ্ধি পেল ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে বাঈ হরকার গর্ভে তাঁর প্রথম পুত্র সেলিমের জন্মের ফলে। ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আকবরের অপর পুত্র দানিয়েলের জন্ম হলে তাকে অম্বরে পাঠানো হয় বড়ো হয়ে ওঠার জন্য।

রাজপুতানার সঙ্গে আকবরের সম্বন্ধ আরও নিবিড় হয় ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে চিতোর এবং ১৫৬৯-৭০ খ্রিস্টাব্দে রণথম্বোরের পতনের পর। ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আকবর যখন নাগোরে অবস্থান করছেন সেই সময়ে বিকানীরের রাজা কল্যাণমল পুত্র রাই রাই সিংহকে নিয়ে তাঁর সঙ্গে মিলিত হন। কল্যাণমলের ভাইয়ের এক কন্যাকে আকবর বিবাহ করেন। ঠিক এমনিভাবে জয়সলমীরের রাওয়াল হর রাইয়ের কন্যাকে ও যোধপুরের রাজা চন্দ্রসেনের কন্যাকে সম্রাট বিবাহ করেন। যদিও বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপিত হয়নি, তথাপি শিরোহী এবং বাঁশওয়ারার রাজারাও মুঘলদের অধীনতা স্বীকার করে মনসব এবং জাগীর লাভ করেছিলেন।

পুত্র সেলিমের সঙ্গেও রাজপুত কন্যাদের বিবাহের কূটনীতির সূত্রপাত করলেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে যুবরাজ সেলিমের সঙ্গে ভগবদ্ভদাসের কন্যা মান বাঈয়ের বিবাহ হল। ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে মোটারাজকে আকবর যোধপুর ফিরিয়ে দেন। অল্পদিন পরে মোটারাজার কন্যা জগৎ গোঁসাইয়ের সঙ্গে সেলিমের বিবাহ হয়। জগৎ গোঁসাই ছিলেন খুমের জননী। একই সময়ে সেলিম বিকানীরের রাই রাই সিংহের কন্যাকে বিবাহ করেন। জয়সলমীরের রাওয়াল ভীমের কন্যাকেও তিনি বিবাহ করেন।

রাজপুত রাজাদের সাহায্যে আকবর যেমন মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের ব্যবস্থা করেন তেমনি রাজপুতদেরও আর্থিক সমৃদ্ধির পথ তৈরি করে দেন। কিন্তু কোনও সময়েই তিনি তাঁর সার্বভৌমত্বের অধিকার বিস্মৃত হননি। সুযোগমতো তিনি তার প্রয়োগ ঘটিয়ে রাজপুতানায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতা বজায় রাখেন। ১৫৬৩ থেকে ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দ—এই দীর্ঘ কুড়ি বছর মাড়ওয়ারের রাজা রাও মালদেবের মৃত্যুর পর গদি নিয়ে চন্দ্রসেন এবং রাম রাইয়ের দ্বন্দ্বের সুযোগে আকবর সমগ্র যোধপুর স্বহস্তে রাখেন, যদিও যোধপুর ছিল মালদেবের ওয়াতন।

তিনি যোধপুর নিজের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ উদয় সিংহ বা মোটারাজাকে দেন। আবার ১৫৭২-৭৩ খ্রিস্টাব্দে নাগরকোটের রাজা জয়চাদ বিদ্রোহ করলে তিনি নাগরকোট দখল করে রাজা বীরবরকে জাগীর হিসাবে বণ্টন করেছিলেন। স্থানীয় মানুষ কিন্তু এই ব্যবস্থা মানতে পারেনি এবং তারা বিদ্রোহ পর্যন্ত করেছিল। আকবর তাঁর সিদ্ধান্ত বদল করে নতুন বশ্যতার চুক্তির মাধ্যমে জয়চাঁদের হাতেই আবার নাগরকোট তুলে দেন।

মাড়ওয়ারের মতোই উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সমস্যার সুযোগ ১৫৯২-৯৩ খ্রিস্টাব্দে আকবর ভট্টা নিজের হাতে নিয়ে নেন এবং ১৫৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে তা রাজকুমার দানিয়েলকে জাগীর হিসাবে বণ্টন করা হয়। নাগরকোটের অধিবাসীদের মতোই এখানে প্রজাদের বিদ্রোহ দেখা দেওয়ায় ১৬০২-০৩ খ্রিস্টাব্দে আকবর পূর্বতন রাজপরিবারের সদস্য বিক্রমজিৎকে ভট্টা ছেড়ে দেন।

আকবর রাজপুতানায় মৈত্রীর নীতি নিলেও বাস্তববোধ কোনও সময়ে বর্জন করেননি। যেমন ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে রাজা উদয় সিংহকে কেবলমাত্র যোধপুর দুর্গের অধিকার দেওয়া হয়, সমগ্র মাড়ওয়ার নয়। তেমনি ১৬০২-০৩ খ্রিস্টাব্দে রাও দুর্যোধন কেবলমাত্র বন্ধুগড়ের স্বত্ব লাভ করেন। সুযোগ পেলেই আকবর এইসব রাজ্যের এলাকাগুলিকে খালিস-এ পরিণত করতেন। রাজপুত রাজার মনসব পদের বেতনের জন্য জাগীর তিনি নির্দিষ্ট করতেন অন্যত্র। এক্ষেত্রে তিনি অম্বরকেও রেহাই দেননি। ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে অম্বরের সঙ্গানির পরগনা তিনি কাছোয়াদের কাছ থেকে নিয়ে রামদাস উদায়কে জাগীর হিসাবে বণ্টন করেন। পুনরায় ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে অম্বর পরগনায় পুনালিয়া গ্রাম তিনি ধরমদাস যোশী নামক এক ব্রাহ্মণকে নিষ্কর হিসাবে দান করেন।

১৫৭৬-৭৭ খ্রিস্টাব্দে শিরোহীর রাও সুরতান মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করলেও আকবর শিরোহীর কিছুটা এবং আবুগড় সৈয়দ হাসিম বুখারীকে জাগীর হিসাবে বণ্টন করেন। পরবর্তীকালে এই রাজ্য গুজরাটের সুবেদারের জাগীর হিসাবে চিহ্নিত ছিল। শিরোহীর অপর অংশ আকবর রানা প্রতাপের ভাই জগমালকে জাগীর হিসাবে বণ্টন করেন।

আকবর যে কেবলমাত্র রাজাদেরই মনসবপ্রদান করে মুঘল পক্ষে এনেছিলেন তা নয়, তিনি সেইসব রাজাদের অধীনস্থ সামন্তদেরও একইভাবে নিজ পক্ষে আনেন। বহু ক্ষুদ্র রাজপুত সামন্ত (স্থানীয় ভাষায় যাদের ঠিকানাদার এবং পাট্টাদার বলা হত) মুঘল মনসব ভোগ করতে শুরু করে যাদের অনেকেই ওয়াতন জাগীর ভোগ করত। যেমন অম্বরের অধীন দেওসা, নরাইনা, লাওন, সম্ভর এবং অমরসরের সামন্তরা কাছোয়াদের পূর্বতন রাজ্যেই ওয়াতন লাভ করে বংশানুক্রমিকভাবে মুঘলদের সেবা করেছিল।

এই প্রক্রিয়া অবলম্বনের ফলে রাজপুতানায় শক্তিশালী রাজ্যগুলির পূর্বেকার আধিপত্য নষ্ট হয়ে যায়। কাছোয়া রাজাদের যিনি প্রভু, তিনিই হলেন কাছোয়াদের পূর্বতন সামন্তদের প্রভু। এভাবেই আকবর সম্রাটের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে দৃঢ় করেন এবং তা প্রসারিত করেন। রাজপুতানায় যেসব রাজন্য ও সামস্ত মুঘলদের মনসব গ্রহণ করলেন তাঁরা যে শুধু আকবরের সম্পদ ছিলেন তা নয়, তাঁদের মাধ্যমে আকবর বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের আনুগত্য অর্জন করলেন।

কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজার জাত ও গোত্র তাঁর অধীনস্থ প্রজার জাত বা গোত্র একই ছিল। তাঁর অনুসৃত নীতির দীর্ঘমেয়াদী ফল ছিল। যেমন, উজবেক বিদ্রোহের সময়ে রাজা ভারামল এবং তাঁর পুত্র ভগবন্তদাস উভয়েই আকবরের পক্ষে ছিলেন। ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে মুঘল বাহিনী রাজপুতানায় মেরতা আক্রমণ করলে অম্বর মুঘল পক্ষে যুদ্ধ করেছিল।

গুজরাট অভিযানকালে ভগবত্তদাসের পুত্র ভূপত মুঘল পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে সারনালে প্রাণ দেন। আকবর এই ঘটনায় এতই ক্রুদ্ধ হন যে গুজরাটে মুহম্মদ হুসেন মির্জার সম্পর্কিত ভাই এবং ভূপতের হত্যাকারী শাহ মদাদকে বন্দি অবস্থায় স্বহস্তে হত্যা করেন।

গুজরাট অভিযানের সময়ে আকবর মেবারের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে বিকানীরের রাই রাই সিংহকে যোধপুর ও শিরোহীর দায়িত্ব দেন। গুজরাট যুদ্ধে অম্বর ছাড়াও রণথম্বোরের রাও সুরমল হাড়া এবং শেখাওয়াতের রাইসাল দরবারীও মুঘলদের সঙ্গে ছিলেন।

১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে রাজনৈতিক কারণে আকবর অধিকমাত্রায় রাজপুতদের ওপর নির্ভরশালী হয়ে পড়েন। ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে মহজর ঘোষণাপত্র জারি করে রাজধানী উলেমা শরিয়ত সংক্রান্ত প্রশ্নে ইসলামের বিভিন্ন মতের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে আকবরকে তার মীমাংসার অধিকার দেয়। এই ঘটনার পর সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নানারকম অসন্তোষ দেখা দেয়। তুরানি অভিজাতরা আকবরের ওপর আর তুষ্ট না থাকায় সম্রাট রাজপুতদের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে যুদ্ধের দায়িত্ব দেন। এমনকি তাঁর নিজেরই ভাই মির্জা হাকিমের বিরুদ্ধেও তিনি রাজপুত সেনা নিয়োজিত করেছিলেন। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে মির্জা হাকিমকে উৎখাত করার জন্য আকবর স্বয়ং লাহোরে আসেন।

তিনি মান সিংহকে সিন্ধু নদী অতিক্রম করে কাবুলের উদ্দেশ্যে অভিযানের নির্দেশ দেন। দীর্ঘ ৬০০ বছর পর এই প্রথম কোনও হিন্দু সেনাবাহিনী সিন্ধু অতিক্রম করে পশ্চিমে রওনা দিল। কাবুলে রাজপুতরা মির্জা হাকিমকে অতি সহজেই পরাস্ত করে এবং আকবর কাবুলে উপস্থিত হয়ে মির্জা হাকিমকে ক্ষমা প্রদর্শন করেন এবং কাবুল ফিরিয়ে দেন। কিন্তু সামরিক ব্যবস্থার পুরো দায়িত্ব তিনি মান সিংহকে দিয়েছিলেন। তাঁকে সিন্ধু অঞ্চলের শাসনভার দেওয়া হয়। ভগবন্তদাস ও সঈদ খানকে ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে যুগ্মভাবে লাহোরের শাসনভার দেওয়া হয়। ১৫৮৩-৮৪ খ্রিস্টাব্দেই সাম্রাজ্য শাসনের জন্য আকবর ঘনিষ্ঠ কিছু হিন্দু ও মুসলমান অভিজাতকে নিয়ে এক মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন।

কিন্তু এ বিষয়ে আবুল ফজল নীরব থাকায় মনে হয় কাজের কাজ কিছু হয়নি। তবে এক বছরের মধ্যেই সুবা-গুলি পুরোমাত্রায় গঠিত হলে আকবর রাজপুতদের অনেক সুবা-র দায়িত্ব অর্পণ করেন। ১৫৮৫-৮৬-তে কাবুলের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশের দায়িত্ব মান সিংহকে দেওয়া হল। পরবর্তীকালে তাঁকে দুর্যোগপূর্ণ বাংলা ও বিহারে একই দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিল। ১৫৯০-৯১ খ্রিস্টাব্দে বিকানীরের রাই রাই সিংহ লাহোরের শাসনকর্তা হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন।

এ প্রসঙ্গে ড. সতীশচন্দ্র বলেন যে, মির্জা হাকিমের বিদ্রোহের মধ্য দিয়েই মুঘল-রাজপুত মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় হতে পেরেছিল। এরপর থেকে আকবর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে রাজপুত বাহিনীকে পাঠিয়েছিলেন। এর মধ্যে বাংলা যেমন ছিল তেমনি দাক্ষিণাত্যও ছিল।

অপরদিকে রাজপুতদের কাছে মুঘল দরবারের চাকরি ছিল যথেষ্ট লাভজনক। অধিকাংশ স্থলেই তাদের মনসব পদ অনুসারে বেতন ছিল মোটা অঙ্কের। যদিও রাজপুতানার নিজস্ব রাজ্যকে ওয়াতন জাগীর (বংশানুক্রমিক) হিসাবে গণ্য করা হত, তথাপি সেখান থেকে আদায়ীকৃত রাজস্ব ও মনসব পদের বেতন অধিক ক্ষেত্রেই এক অঙ্কের হত না। ফলত অন্যত্র রাজপুত মনসবদাররা তন্যা জাগীর (যা পরিবর্তনশীল) লাভ করত। এভাবে তাদের আয়ের এক উৎস খুলে যায় ও তারা রাজপুতানার বাইরে থেকে সম্পদ আদায় করে এনে সঞ্চয় করতে থাকে।

উপসংহারে বলা যায় যে, একমাত্র উদয়পুর (চিতোর) ছাড়া রাজপুতানার যাবতীয় রাজশক্তি ১৫৭৬-৭৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। আকবর রাজপুতানাকে আজমিড় সুবা-র অন্তর্গত করেন। কোনও কোনও অঞ্চলে বিদ্রোহ অবশ্যই হয়েছিল তথাপি উল্লিখিত বছরের শুরুতেই ডুঙ্গরপুর, বাঁশওয়ারা, জালোর ও শিরোহীর অধীনতা স্বীকারের মাধ্যমে রাজপুতানায় মুঘল কর্তৃত্ব সুনশ্চিত হয়েছিল। এভাবেই গুজরাটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছিল।

কিছু ক্ষেত্রে রাজপুত রাজ্যগুলির পারস্পরিক বিরোধের সুযোগও আকবর নিয়েছিলেন। যেমন মাড়ওয়ারের মেরতার শাসক তাঁর পরাক্রমশালী প্রতিবেশীর হাত থেকে বাঁচার জন্য মুঘলদের আশ্রয় ভিক্ষা করেন ও লাভ করেন।

আকবর অবশ্য সার্বভৌম শাসক হিসাবে রাজপুত রাজ্যগুলিকে সুযোগ বুঝে নিয়ন্ত্রণ করার প্রক্রিয়া চালু রেখেছিলেন। মনসব পদ গ্রহণের মাধ্যমে রাজপুত রাজ্যগুলি আক্ষরিক অর্থে নিজেদের স্বাধীনতা খুইয়েছিল। ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে যোধপুরের রাও মালদেবের মৃত্যুর পর আকবর মৃতের জ্যেষ্ঠ পুত্র রামকে উত্তরাধিকারী হিসাবে গ্রহণ করেন যদিও মালদেবের ইচ্ছা ছিল কনিষ্ঠ পুত্র চন্দ্রসেন তাঁর উত্তরাধিকারী হবেন। দুই ভাইয়ে বিরোধ দেখা দিলে আকবর ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যোধপুরকে খালিস হিসাবে শাসন করেছিলেন। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে যোধপুর বিকানীরের রাই রাই সিংহকে দেওয়া হয়, কিন্তু ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় তাকে খালিস করা হয়। অবশেষে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে মোটারাজা উদয় সিংহকে যোধপুর ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

সার-সংক্ষেপ

সম্রাট আকবর রাজ্যের স্থায়িত্ব ও বিস্তৃতির লক্ষ্যে রাজপুতদের প্রতি শুধুমাত্র মিলনার নীতি। সমর্থন করেননি, তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা করেন। তাঁর রাজপুত নীতির ফলে সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছিল।

রাজপুত নীতির ফলাফল।

সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতি মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ করে। এই নীতির ফলে মুঘল সম্রাটগণ চারপুরুষ ব্যাপী রাজপুতদের সমর্থন ও সেবা লাভ করে। এ ছাড়াও হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়ে এক মিশ্র বৃষ্টির উদ্ভব হয় যার স্পষ্ট স্থাপ ভারতীয় স্থাপত্যশিল্পে বিদ্যমান। এই নীতির ফলে ভারতবর্ষে উর্দু ভাষা সৃষ্টির পথ সুগম হয়।

Leave a Reply