পানিপথের যুদ্ধ  – প্রথম,দ্বিতীয়,তৃতীয় “কারণ ও ফলাফল”
পানিপথের যুদ্ধ - প্রথম,দ্বিতীয়,তৃতীয় কারণ ও ফলাফল

পানিপথের যুদ্ধ – প্রথম,দ্বিতীয়,তৃতীয় “কারণ ও ফলাফল”

1️⃣ প্রথম পানিপথের যুদ্ধ

প্রথম পানিপথের যুদ্ধ কেন সংঘটিত হয়েছিল ?

এই যুদ্ধে বাবর ব্যবহার করেন বিখ্যাত ‘তুলুগমা’ ও ‘আরাবা’ কৌশল। ফলে বাবরের সৈন্যবাহিনী ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ঘিরে ফেলেছিলো লোদীর সমগ্র সৈন্যবাহিনীকে। এতে বিভ্রান্ত হয়ে পরে লোদীর সৈন্যরা। উপায় না দেখে ইব্রাহিম লোদী তার হস্তিবাহিনী দিয়ে আক্রমণ শুরু করেন।

🇶🇦 প্রথম পানিপথের যুদ্ধের ফলাফল ও গুরুত্ব,

১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দে ২১ এপ্রিল, প্রথম পানিপথের যুদ্ধ হয়। 

স্থান- ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের পানিপথ গ্রামে। প্রথম পানিপথের যুদ্ধ আফগান সুলতান ইব্রাহিম লোদী এবং মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের মধ্যে সংঘটিত হয়। ইব্রাহিম লোদীকে পরাজয়করে বাবর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে।

প্রথম পানিপথের যুদ্ধে মুঘল শক্তি তথা বাবরের কাছে দিল্লীর আফগান সুলতান ইব্রাহিম লোদীর পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে ভারতে মুঘল শাসনের সূচনা হয়েছিল। এই যুদ্ধের ফলে দিল্লী ও আগ্রা বাবরের হস্তগত হয় এবং তিনি ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল দিল্লীর জুমা-মসজিদে নিজ নামে খুৎবা পাঠ করেন। এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে লোদী শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারতে আফগান সাম্রাজ্যের ধ্বংস সুনিশ্চিৎ হয়।

আগ্রায় লোদীদের কোষাগার বাবরের দখলে আসায় তার অর্থ সংকট কিছুটা দূর হয়। আগ্রা থেকে জৌনপুর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে মুঘল কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। তাই ঐতিহাসিক আর. এস. ত্রিপাঠী – এই যুদ্ধকে এক চূড়ান্ত ক্ষমতা নির্ণায়ক যুদ্ধ (A decisive war) বলে অভিহিত করেছেন। আবার সতীশচন্দ্র মন্তব্য করেছেন যে ভারতের ইতিহাসে চূড়ান্ত যুদ্ধগুলির মধ্যে পানিপথ অন্যতম। কিন্তু তিনি এটাও বলেছেন যে – রাজনৈতিক দিক থেকে বিচার করলে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ততটা চূড়ান্ত ছিল না। কেননা তখনও মেবারের রাজপুত ও পূর্ব ভারতে আফগানরা যতেষ্ট শক্তিশালী ছিল।

যে কারণে বাবরকে খানুয়ার যুদ্ধ (১৫২৭ খ্রি.) ও ঘর্ঘরার যুদ্ধে (১৫২৯ খ্রি.) অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। ড. কে. কে. দত্তর মতে পানিপথের বিজয়ের ফলে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য সুচারুরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং বলা যায় – যুদ্ধে বাবরের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়, ও এই যুদ্ধ জয়লাভের ফলে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রথম ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়। পানিপথের এই যুদ্ধে তার জয়লাভ তার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে। তার কামান বন্দুক তথা আগ্নেয়াস্ত্রধারী সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রথম সোপান রচিত হয়।

প্রথম পানিপথের যুদ্ধে বাবরের সাফল্যলাভের কারণসমূহ,

প্রথম পানিপথের যুদ্ধে বাবরের জয়লাভের পিছনে নানা বিষয় কার্যকর ছিল।

1. সাম্রাজ্যের শেষ পর্বে রাষ্ট্রে কোনো সংহতি ছিল না। সুলতানী শাসনে একাধিক শক্তিশালী ও প্রায় স্বাধীন রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। ইব্রাহিম লোদীর রাজত্বকালে সুলতানী সাম্রাজ্যের সংহতি একেবারে শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছিল।

2. ইব্রাহিম লোদীর সৈন্যসংখ্যা বেশি থাকলেও এই সেনাবাহিনী ছিল অদক্ষ ও অভিভঃ 

3. সুলতানী সেনাদের সম্মুখে কোনরূপ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আদর্শ ছিল না অর্থাৎ ধর্মীয়,

4. বিভিন্ন গোষ্ঠী থেকে সেনা সংগ্রহ করার ফলে তাদের মধ্যে একতাবে ছিল না। তারা গোষ্ঠী নেতাদের প্রতি বেশী অনুগত ছিল।

5. দুর্বল ও প্রাচীনপন্থী সামরিক ব্যবস্থার মতো সুলতানী সেনাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল প্রাচীন তীরধনুক, রথ, হস্তী ও পদাতিক সেনাবাহিনী। 

6. সুলতানী বাহিনীর সাহস থাকলেও কুটকৌশলে তারা বাবরের চেয়ে সহস্রগুণ পিছিয়ে ছিল একাধিক শক্তিশালী ও প্রায় স্বাধীন রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। ইব্রাহিম লোদীর রাজত্বকালে সুলতানী সাম্রাজ্যের সংহতি একেবারে শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছিল। ও জাতীয়তাবাদী আদর্শ বা ভাবাবেগ কাজ করেনি।

7. ইব্রাহিম লোদীর ভ্রান্ত নীতি ও আফগান অভিজাতদের প্রতি তার সন্দেহ – পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছিল।

8. বাবরের উন্নত রণকৌশল। বাবর মধ্য এশিয়াতে উজবেক, তুর্কী, পারসিক, আফগান বিভিন্ন জাতির রণকৌশলের সমন্বয় ঘটিয়ে এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। তুলঘুমা যুদ্ধপদ্ধতি ও রুমি কৌশলে বাবর সাফল্যলাভ করেছিলেন।

9. ভারতের বিভিন্ন শাসকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, আত্মকলহ ও অনৈক্য বাবরের সামনে সুবর্ণসুযোগ এনে দিয়েছিল

10. যুদ্ধক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র অর্থাৎ গোলা-বারুদের ব্যবহার ভারতীয়দের অজানা ছিল। যে কারণে বাবরের পক্ষে গোলন্দাজ বাহিনী অতি সহজেই সুলতানী বাহিনীকে পরাজিত করেছিল। এছাড়াও নেতা ও সেনাপতি হিসাবে ইব্রাহিম লোদী বাবরের সমকক্ষ ছিলেন না। ফলে, বাবর স্বয়ং তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন — Indians know how to die and not how to fight .. পানিপথের প্রান্তরে মুঘল শক্তি তথা বাবরের জয়লাভ ও আফগান সুলতান ইব্রাহিম লাগে দীর পরাজয় ঘটেছিল।

2️⃣ দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধ

দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধ ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর হিন্দু জেনারেল ও আদিল শাহ সুরির প্রধানমন্ত্রী হেমুর বাহিনী এবং মুঘল বাদশাহ আকবরের বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল।

হেমু আক্রমণ শুরু করেছিলেন এবং মুঘলদের ডান ও বাম অংশের উপর হাতি ছেড়ে দিয়েছিলেন।যে সব সৈন্য এই গন্ডগোল এড়াতে পেরেছিল,তারা পিছু হটার বদলে পাশে চেপে গিয়েছিল এবং তাদের উন্নত ধনুর্বিদ্যার সাহায্যে তীর বর্ষণ করে, হেমুর অশ্বারোহী সেনাবাহিনীর পার্শ্বদেশ আক্রমণ করেছিল। মুঘলদের মধ্যভাগ এগিয়ে এসেছিল এবং একটি গভীর গিরিখাতের আগে রক্ষনাত্মক অবস্থান নেয়। হেমুর হাতী বা অশ্ববাহিনী কেউই প্রতিপক্ষের নাগাল পেতে খাত অতিক্রম করতে পারেনি এবং অন্য পক্ষ থেকে ছোড়া ছুটন্ত অস্ত্রের আঘাতের জন্য নাজুক অবস্থায় ছিল। ইতোমধ্যে মুঘল অশ্বারোহি সেনাবাহিনী তাদের দ্রুতগামি বাহনে চড়ে পাশ থেকে ও পেছন থেকে হেমুর সৈন্য বাহিনীর ভেতর ঢুকে পড়েছিল এবং বিশাল পশুটির পায়ে খোঁচা মেরে বা মাহুতকে ফেলে দিয়ে হাতিকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা আরম্ভ করেছিল। হেমু তার হাতীকে টেনে থামিয়ে ছিলেন এবং আফগান আক্রমণের তীব্রতা হ্রাস পায়।

আফগান আক্রমণ শিথিল হয়ে যাচ্ছে দেখে আলি কুলি খান চারিদিক ঘুরে এবং পেছন দিক থেকে আফগান মধ্যভাগে আক্রমণের জন্য তার অশ্বারোহী সেনাদলকে নির্দেশ দেন। হাওয়াই এর উপর হাওদায় বসে যুদ্ধ পর্যবেক্ষন করে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। সাদি খান কাক্কর এবং তার আরেকজন যোগ্য সেনাপতি ভগবান দাসকে পরাজিত দেখার পরও তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতি-আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন এবং তার হাতীকে বাধা দিতে আসা যে কাউকে সরিয়ে দিচ্ছিলেন।

এটা ছিল বেপোরোয়া ভাবে লড়াই করা যুদ্ধ; কিন্তু মনে হয়েছিল যুদ্ধের প্রাধান্য হেমুর দিকে ঝুকে পড়েছে. মুঘল সেনাবাহিনীর উভয় অংশকেই পিছনের দিকে খেদিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের মধ্যভাগকে গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য হস্তীবাহিনী ও অশ্বারোহী সেনাদলকে সামনে চালনা করেছিলেন। হেমু যখন সম্ভাব্য বিজয়ের চূড়ায়,মুঘলদের ছোড়া একটি তীর দৈবাৎ তার চোখে আঘাত করে আহত করেছিল এবং তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। তাকে পড়ে যেতে দেখে তার সেনাবাহিনীর ভেতর আতঙ্কের সূত্রপাত হয়েছিল যা বিন্যাস ভেঙে গিয়েছিল এবং তারা পালিয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধে হার হয়েছিল; যুদ্ধের ময়দানে ৫০০০ লাশ পড়েছিল এবং পালানোর সময় আরো অনেককে হত্যা করা হয়েছিল।

🇶🇦 দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধের কারণ কি উল্লেখ করো ?

হুমায়ুনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে হিমু দিল্লি ও আগ্রা দখল করেন। হিমু বিক্রমাদিত্য উপাধি নিয়ে নিজেকে দিল্লির সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। বৈরাম খাঁ ও আকবর দিল্লি পুনরুদ্ধারের জন্য সসৈন্যে দিল্লির দিকে অগ্রসর হন। পানিপথের প্রান্তরে মোগল ও আফগানদের সংঘর্ষ হয় (১৫৫৬ খ্রি.) মূঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের উত্তরসূরি হুমায়ূন ১৫৪০ সালে শের শাহের নিকট রাজত্ব হারিয়েছিলেন।

১৫৪৫ সালে শের শাহের মৃত্যু হলে উত্তরসূরী হয় তাঁর ছোট ছেলে ইসলাম শাহ সূরি। কিন্তু ১৫৫৩ সালে ইসলাম শাহ সূরির মৃত্যুর পর, সূর সাম্রাজ্য উত্তরাধিকার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং প্রদেশসমূহে বিদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। এমতাবস্থায়, হুমায়ুন হারানো রাজত্ব ফিরে পেতে এই বিদ্রোহ কাজে লাগান এবং ১৫৫৫ সালের ২৩শে জুলাই, মুঘলরা সিকান্দার শাহ সুরি কে পরাজিত করে, এবং সবশেষে দিল্লী ও আগ্রার উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়। 

হেম চন্দ্র ছিল আদিল শাহর প্রধানমন্ত্রী এবং সূরি সেনাবাহিনীর জেনারেল। ১৫৫৬ সালের ২৬ জানুয়ারি, হুমায়ুনের মৃত্যুর সময়, হেম চন্দ্র বাংলায় ছিলেন। মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যু মুঘলদের পরাজিত করার ও হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধার করার আদর্শ সুযোগ করে দিয়েছিল।

হেমু বাংলা থেকে দিল্লীতে দ্রুত যাত্রা করে এবং মুঘলদের  বায়ানা, ইতাহা, সাম্ভাল, কালপি এবং নারাউল থেকে তাড়িয়ে দেন। আগ্রাতে হেমুর আসন্ন হামলার সংবাদ পেয়ে যুদ্ধ না করে প্রশাসক পালিয়ে যায়। প্রশাসকের পিছু ধাওয়া করে হেমু দিল্লীর বাইরে তুঘলাকাবাদে পৌছে যান, যেখানে তিনি মুঘল প্রশাসক তারদি বেগ খানের সেনাবাহিনীর দেখা পান এবং তুঘলাকাবাদের যুদ্ধে তাদের পরাজিত করেন। ১৫৫৬ সালের ৭ অক্টোবরের যুদ্ধের পর, হেমু দিল্লী দখল করে এবং বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করেন। যুদ্ধে প্রায় ৩,০০০ মুঘল নিহত হয় এবং ৩৫০ বছর মুসলিম শাসনের পর উত্তর ভারতে হিন্দু শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়।

3️⃣ তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধ.

ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের ভাঙনের সময়কালে মারাঠারা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে আর সে জন্যই তারা উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারে প্রয়াসী হয়ে পড়ে। এই সময় তাদের এই প্রয়াসের বাস্তব রূপ ফুটে ওঠে প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে মারাঠা আধিপতা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়- কার্যক্ষেত্রে দিল্লির সম্রাট ছিলেন তাদের কাছে নামমাত্র। অবশ্য, মারাঠাদের কৃতিত্ত্বের মূলে যাদের প্রচেষ্টা সর্বাপেক্ষা অগ্রগণ্য তারা হলেন ‘পেশোয়া’ বা মারাঠা রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। প্রসঙ্গত, বালাজি বাজিরাও (১৭৪০-১৭৬১ খ্রী:) সম্পর্কে দু চার কথা বলে যেতে পারে। তবে এখানে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের কারণ ও গুরুত্ব সম্পর্কে মূল আলোচনা উপস্থাপন করা হয়েছে।

🇶🇦 তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধের কারণ.

বাজিরাও-র মৃত্যুর পরে তার পুত্র বালাজি বাজিরাও মাত্র ১৮ বছর বয়সে পেশোয়া পদ লাভ করেন। অবশ্য, পিতার মহৎ গুনাবলীর কোনোকিছুই তার মধ্যে ছিল না। তাই সামরিক কার্যাদির জন্য তাকে সর্বদাই সামন্ত প্রভুদের উপর নির্ভরশীল হতে হত। শাসনব্যবস্থায় তাঁর। কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল মূলত রাজধানী স্থানান্তরকে কেন্দ্র করেই। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পেশোয়া পদের বংশানুক্রমিক ধারাবাহিকতা। আর এই বংশানুক্রমিকতা শাহু কর্তৃক পেশোয়া পদের আইনগত বৈধতার মধ্য দিয়ে প্রকৃতঅর্থে পেশোয়া হয়ে ওঠেন সর্বেসর্বা।

বাস্তবিকই বালাজি বাজিরাও ছিলেন ঘোরতর সাম্রাজ্যবাদী শাসক। তাঁর লক্ষ্য ছিল “দক্ষিণে কটক থেকে উত্তর – পশ্চিমে আটক পর্যন্ত মারাঠা পতাকা উড্ডীন করা। তাই তাঁর আমলে যেমন মারাঠা সাম্রাজ্যের যেমন সর্বাধিক বিস্তৃতি ঘটে তেমনি সাম্রাজ্যের চরম বিপর্যয়ও ঘটে।

বালাজি বাজিরাও প্রশাসনিক দিক থেকে যেমন নেতিবাচক পন্থা গ্রহণ করে পূর্বোক্ত ‘হিন্দু-পাদ-পাদশাহি’ নীতি ত্যাগ করেছিলেন তেমন রণকৌশলেও ঘটিয়েছিলেন ভ্রান্ত পরিবর্তন। এই দ্বৈত নীতি ছিল তাঁর অযোগ্যতার ভ্রান্ত নীতির পরিচায়ক। প্রথমটির ক্ষেত্রে তিনি হিন্দু রাজাদের মৈত্রীবন্ধন ছিন্ন করে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে নিজের বিপদ ডেকে আনেন। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতে মারাঠা বাহিনীতে অ-হিন্দু ও বিদেশী সৈনিক গ্রহণ করে সেনাবাহিনীর জাতীয় সংহতি বিপন্ন করেন পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের জন্য বালাজি বাজিরাও এর সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব তথা বিপুল পরিমান রাজ্যজয় অনেকাংশে দায়ী ছিল। যে সমস্ত রাজ্যগুলি তিনি জয় করেছিলেন সেগুলি নিম্নে প্রদান করা হল।

(১) মহীশূরের কিছু অংশ।

(২) কাটিক।

(৩) বিজাপুর, দৌলতাবাদ ও অসিড়গড় ।

(৪) উড়িষ্যা ।

(৫) দিল্লি (এখানে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়)।

(৬) লাহোর।

এইভাবে সিন্ধুনদ থেকে দাক্ষিণাত্যের সীমানা পর্যন্ত মারাঠা অধিকার বিস্তৃত হয়। কিন্তু বৈদেশিক আক্রমণ, অভ্যন্তরীন রাজনীতি সম্পর্কে বালাজির রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাব ছিল অফুরন্ত এর পরিনতি সম্পর্কে তিনি সজাগ ছিলেন না বা প্রস্তুত ছিলেন না।

উপরিউক্ত পরিস্থিতিতে বালাজি বাজিরাও পাঞ্জাব দখল করলে আহম্মদ শাহ আবদালির সঙ্গে মারাঠাদের সংঘর্ষ প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। একথা স্বীকার্য পাঞ্জাবে মারাঠাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখানে শান্তি শৃঙ্খলার প্রত্যাবর্তন হয়নি। ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ অক্টোবর, আদিনা বেগ খান মৃতমুখে পতিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র পাঞ্জাবের অরাজকতা ও বিশৃঙ্খল ভাদশার মূর্ত প্রকাশ ঘটে। এমতাবস্থায় সিভিয়ার নেতৃত্বে পেশোয়া এক শক্তিশালী বাহিনী প্রেরণ করেও শেষ রক্ষা হয়নি। অতি অল্প দিনের মধ্যেই আবদালির এক শক্তিশালী বাহিনী পাঞ্জাব আক্রমণ করে এবং ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাস নাগাদ মারাঠাদের হাত থেকে, পাঞ্জাবকে ছিনিয়ে নেয়। এই সময় দিল্লিরও বিশেষ কোন সামরিক ক্ষমতা ছিল না।

এছাড়া মারাঠা কার্যকলাপে হিন্দু-মুসলমান উত্তর শাসকরাই ছিলেন অসন্তষ্ট। তাই মারাঠারা যথাসময়ে সহযোগীতা যে ডাক দিয়েছিলেন তাতে কেউই কর্ণপাত করেননি। এদিকে আবদালি মালবের ভূতপূর্ব শাসক আহম্মদ শাহ বাঙ্গামকে নিজ দলে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু মারাঠারা সেই সময় ভারতের অন্যতম শাসক সুজা-উদ-দৌল্লা কে (অযোধ্যার নবাব) নিজেদের দলে আনতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে সুজা-উদ-দৌল্লাও মারাঠাদের বলপূর্বক আক্রমণে সন্ত্রস্ত ছিলেন। তিনি এই মত সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন এবং আবদালির পক্ষ অবলম্বন করে তাদের সমুচিত জবাব দিলেন। এক্ষেত্রে মারাঠাদের একমাত্র সহায় ছিল মুঘল উজির ইমাদ-উল-মূলক, যার কিনা সামর্থ্য ছিল যত সামান্য। এদিকে রাজপুত ও অনান্য হিন্দুশক্তিগুলি নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে। এরূপ পরিস্থিতিতে আহম্মদ শাহ আবদালির শক্তিশালি বাহিনীর বিরুদ্ধে মারাঠারা ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির পাণিপথের প্রান্তরে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হয়।

আহম্মদ শাহ আবদালির সৈনাবাহিনী সংখ্যায় আনুমানিক ৬০,০০০ ছিল আর মারাঠাদের সৈন্যবাহিনী ছিল মোটামুটি ৪৫,০০০। সামরিক প্রতিভার দিক থেকেও আফগান বাহিনী ছিলমারাঠাদের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর। তবে যেটি ঘটেছিল তা হল প্রায় মাড়াই মাস কেউ কাউকে আক্রমণ না করে একেবারে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পানিপথের প্রান্তরে দাঁড়িয়েছিল। এদিকে রসদাদির অভাবে মারাঠা সৈন্যদলের দুরবস্থা চরমে পৌঁছয়। এরূপ নিরুপায় অবস্থায় ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ই জানুয়ারি মতান্তরে ১৫ ই জানুয়ারি মারাঠারা আবদালির সৈন্যদলকে আক্রমণ করায়, উভয়পক্ষের মধ্যে এক প্রবল যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাসে ‘পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ’ নামে খ্যাত।

🇶🇦 তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে মারাঠাদের ব্যর্থতার কারণসমূহ.

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠাদের ব্যর্থতা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বাদানুবাদ রয়েছে আচার্য যদুনাথ সরকার লিখেছেন “The military disaster to the Marathas at Panipath : was inevitable” অবশ্য দেওয়ালকার (shijwalker) আচাৰ্য সরকারের বক্তব্যের তীব্রভাবে বিরোধীতা করেছেন। এই বিতর্কের মধ্যে না গিয়ো সহজ করে বললে বিষয়টি এমন দাঁড়ায় মারাঠাদের ব্যর্থতা ছিল তাদের যুদ্ধ প্রকরণের প্রাপ্তি ও নেতৃবৃন্দের তুল-ভ্রান্তি। সৈন্য, সংখ্যাও এখানে বিচার্য্যের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় পূর্বেই তা উল্লেখিত। আর এর সাথে যুক্ত হয় রসদ।

প্রথমত, সামরিক সংগঠন ও রণকৌশলে আফগানরা ছিল বহু যোজন এগিয়ে, কিন্তু মারাঠাদের প্রকৃত শক্তি নিহিত ছিল মারাঠা পদাতিক, হাল্কা দ্রুতগতিসম্পন্ন অশ্বারোহী বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ ও গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতির উপর। কিন্তু এগুলির কোনোটির ওপর নির্ভর না করে গোলন্দাজ বাহিনী ও এই সেনাদের রণকৌশলের ওপর নির্ভর করেছিলেন।

দ্বিতীয়ত, আবদালির কামানগুলি ছিল অত্যাধুনিক কিন্তু মারাঠাদের কামানগুলি অতটা আধুনিক ছিল না। সেগুলি ছিল যেমন ভারী তেমনি গতিতে ছিল শথ।

তৃতীয়ত, মারাঠা বাহিনীর রণকৌশল ছিল ভুল। যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে দু’মাসের অধিক শক্তি সঞ্চয় না করে ভিতরে ভিতরে অন্ত:সার হয়ে পড়ে। তাদের এতো সময় অতিক্রান্ত করা একেবারেই সঠিক ছিল না।

চতুর্থত, সেনাদলের অভ্যন্তরীণ নিয়মানুবর্তিতা বা শৃঙ্খলাতে মারাঠা সেনাদল যতটা অপরিণত ছিল, আবনালির সেনাদল ছিল ততটাই পরিণত। প্রসঙ্গত, মারাঠা সেনাদলে অসামরিক ব্যক্তি ও মহিলাদের উপস্থিতি তাদের নানা সমস্যার সম্মুখীন করে তুলেছিল

পঞ্চমত, মারাঠা নেতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বোঝাপড়ার অভাব ছিল প্রবল। সিন্ধিয়া ও হোলকার এই দুই সেনাপতির মধ্যে বোঝাপড়া ও তাঁর ব্যক্তিত্বের সংঘাত ছিল। আবার সদাশিব রাও এর খামখেয়ালিপনা একগুঁয়ে মনোভাব সর্বস্তরে গৃহীত হয়নি। বলাবাহুল্য, তাঁকে সকলে পছন্দ করত না।

তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধে মারাঠাদের ব্যর্থতার জন্য কেবল উপরিউক্ত কারণগুলিই যথেষ্ট এমনটি কিন্তু নয়, মারাঠাদের ব্যর্থতার জন্য পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও এর দায়িত্ব নেহাৎ কম ছিল না। আলোচনার প্রথমে সে দিকটিও তুলে ধরা হয়েছে।

এছাড়াও তৎসময়ে মারাঠাদের উত্তর ভারতের রাজনীতিতে জড়িত হবার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল না। পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে মারাঠারা যে নীতি গ্রহণ করেছিল সেটিও ছিল ভুলে ভরা।

দ্বিতীয়ত, পেশোয়ার যে সামরিক দায়িত্ব নিয়মিত অস্ত্র, খাদ্য, অর্থ, সেনা প্রভৃতি যোগান। দেওয়া তা তিনি দায়িত্ব সহকারে পালন করতে পারেননি।

তৃতীয়ত, যেখানে যে নীতি গ্রহণ করার দরকার ছিল পেশোয়া করেননি। জলা ভারতে যেখানে নিজ হাতে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন ছিল তা তিনি করেননি। এক্ষেত্রে অপদার্থ নেতাদের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করে নিজে শিবিরে ছিলেন। এদিকটি তার অযোগ্যতার পরিচায়ক। গ্রান্ট ডাফ বলেন যে, বালাজি বাজিরাও তার ষড়যন্ত্র প্রবনতা ও প্রতারণামূলক নীতির জন্য মিত্র শক্তি গুলির আস্থা হারান।”

🇶🇦 তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধের গুরুত্ব.

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের গুরুত্ব ও মারাঠা জাতির ভবিষ্যত সম্পর্কে সব ঐতিহাসিক একমত নন। এলফিনস্টোনের পরিভাষা অনুযায়ী, একথা প্রত্যেকেই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিল যে পানিপথের প্রাস্তরে মারাঠা বাহিনীর চরম বিপর্যয় তা যেন এক সার্বিক জাতীয় বিপর্যয়ের মতন ছিল। “It has been a fashion with the Maratha writer to minimise the politi cal result of the battle of Panipath”. ঐতিহাসিক পার্সিভাল স্পিয়ার বলেন যে, পানিপথের যুদ্ধ কেবলমাত্র সামরিক পরাজয় ছিল না, মারাঠা জাতির স্বার্থের পক্ষে এই যুদ্ধ। ছিল বিপর্যয়কর (“The battle of Panipath was not only a defeat but a catastrophie for the Maratha cause”- Dr. P. Spear.)

কিন্তু মারাঠা ঐতিহাসিকরা বিশেষ করে সরদেশাই মারাঠাদের এই পরাজয়কে জাতীয় বিপর্যয় বলে মনে করেন না। তিনি বলেছেন “Not withstanding that terrible losses in manpower suffered on that field by the Maratha, the disaster decided nothing” সরদেশাই এর মতে, এই যুদ্ধে মারাঠা বিপর্যয়ের সুনির্দিষ্ট মীমাংসা হয়নি। এমনকি এই যুদ্ধে মারাঠাদের রাজনৈতিক প্রশ্নেরও মীমাংসা হয়নি (GS. Sardesai, A New His tory of Maratha, vol III.) ।

মেজর ইভান বেলও অবশ্য পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধকে মারাঠা। জাতির গৌরবময় সাফল্য’ বলে অভিহিত করেছেন (Evans Bell, The Amexation of Punjab) এই প্রেক্ষাপটে ইভান বেল-এর সূত্র ধরে সবদেশাই যেটি বলতে চেয়েছেন তার মুল কথা হল মারনোদের সামরিক সাফল্য যেমন দেখা গিয়েছিল তেমনি এক দশকের মাঝে। মান্নার উত্তর তারার করতে সমর্থ হয়েছিল।

সেনাপতির মৃত্যু ঘটে। বিশ্বাস রাও ও সদাশিব রাও যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেন। ইব্রাহিম খান গর্দি বা সামসের বাহাদুরের মত সেনাপতিও আর ছিল না। জীবিত ছিলেন হোলকার, মহাদজ্জী সিন্ধিয়া ও নানা ফড়নবীশ। আচার্য যদুনাথ সরকার তাই যথার্থই বলেছেন

“It was, in short, a nation-wide disaster like flodden field, there was not a in Maharastra that had not mourn the loss of a member, and several houses, their very heads. An entire generation of leaders was cut off at one stroke.

”ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র ঠিকই বলেছেন যে “পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে কারা ভারতবর্ষের শাসক হতে চলেছে তা নির্ধারণ করেনি, কারা শাসক হতে পারবে না তা নির্ধারিত করেছিল (Bipan Chandra, Modern India) । আচার্য যদুনাথ সরকার তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধের গভীর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন যে, তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধ মারাঠাদের ভাগ্য নির্ধারিত করে। এই পরাজয় সমগ্র মারাঠা জাতিকে হতাশাগ্রস্ত করে এবং মারাঠা জাতি এই পরাজয় কে কখনও ভুলতে পারেনি। তারপর মাধব রাও এর অকালমৃত্যু মারাঠা জাতিকে শেষ আঘাত হানে (J.N. Sarkar, Shibaji and His Times)

প্রকৃতপক্ষে, তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যসীমা মীমাংসক যুদ্ধ। ইতিপূর্বে এই পানিপথের প্রান্তরেই ভারতবর্ষের ভাগ্য দু-দুবার নির্ণীত হয়েছে। এবারে মারাঠাদের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের ভাগ্য তৃতীয় বার নির্ধারিত হল, কারণ তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধের ভগ্ন মারাঠা জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আগেই ব্রিটিশরা ভারতে তাদের আধিপতা ও সংহতি সুদৃঢ় করার সুযোগ পায়। তাই আচার্য যদুনাথ সরকার বলেছেন- “If plassey had shown the seeds of British Supremacy in India, Panipath afforded time for their maturing and striking roots. সুতরাং ইংরেজ শক্তির সুদৃঢ় অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সুনিশ্চিত হয়ে উঠেছিল মারাঠাদের চরম ব্যর্থতা ।

Leave a Reply