মোগল যুগের ইতিহাসচর্চা বিশেষ করে মরবারী ইতিহাসের শ্রেষ্ট প্রতিনিধি ছিলেন আবুল ফজল। আকবরের মন্ত্রী, বন্ধু, রাষ্ট্রনেতা, কূটনীতিবিদ ও সামরিক অফিসার আবুল ফজল ইতিহাস রচনায়। সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ঐতিহাসিকের ভূমিকায়, তাঁর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কীর্তি হল আকবর নামা (Akbar-nama) ও আইন-ই-আকবরি (Ani-i Akbari)-র পৃষ্টাগুলিতে আকবরের মহানতার সহজবোধ্য, পূর্ণাকার চিত্র উপস্থাপনে তাঁর সাফল্য। তিনি আবুল-ফজল, আবুল ফদল ও আবুল ফদল ‘আল্লামি নামেও পরিচিত। আবুল ফজল (১৪ জানুয়ারি, ১৫৫১ – ১২ অগস্ট ১৬০২) মুঘল সম্রাট আকবরের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
ভারতবর্ষে মুসলমান শক্তির উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠা যেমন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন প্রবণতার সৃষ্টি করেছিল, তেমনি জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও নতুন এক যুগ বহন করে এনেছিল। মোগল যুগের ইতিহাসচর্চা বিশেষ করে মরবারী ইতিহাসের শ্রেষ্ট প্রতিনিধি ছিলেন আবুল ফজল। আকবরের মন্ত্রী, বন্ধু, রাষ্ট্রনেতা, কূটনীতিবিদ ও সামরিক অফিসার আবুল ফজল ইতিহাস রচনায়। সিদ্ধহস্ত ছিলেন । শৈশবেই তিনি প্রতিচার স্বাক্ষর রেখে ছিলেন।
১৫ বছর বয়সে তিনি জ্ঞানার্জনের সমস্ত শাখায় দক্ষতা লাভ করেন । নির্যাতিত ও অত্যাচারিত পরিবারের দুর্ভাগ্য আবুল ফজলের চিন্তার উপর গভীর ছাপ ফেলেছিল । মোগল সম্রাট আকবরের আশ্রয় তা দৃষ্টপোষকতা লাভ করার পর তিনি রচনা করেন দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আকবরনামা’ ও ‘আইন-ই-আকবরী’।
আবুল ফজলের, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ পদে গণ্য হওয়ার মূল কারণ তাঁর রচনায় বৌদ্ধিক উপাদানের সর্বব্যপী উপস্থিতি, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিবর্তে সর্বদাই যুক্তির পক্ষে তাঁর আবেদন, ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর প্রসারী দৃষ্টি, সে যুগের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সমসাময়িক ইতিহাস ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা, নতুন পদ্ধতিবিদ্যা যা তিনি গৃহীত কর্তব্যে প্রয়োগ করতে মনস্থ করেছিলেন এবং গদ্য রচনায় তাঁর অনন্য আচার্যসুলভ শৈলী। সবশেষে, ঐতিহাসিকের ভূমিকায়, তাঁর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কীর্তি হল আকবর নামা (Akbar-nama) ও আইন-ই-আকবরি (Ani-i Akbari)-র পৃষ্টাগুলিতে আকবরের মহানতার সহজবোধ্য, পূর্ণাকার চিত্র উপস্থাপনে তাঁর সাফল্য।
আবুল ফজল মোট পাঁচটি খণ্ডে আকবরনামা রচনার পরিকল্পনা করেছিলেন। এর মধ্যে প্রথম চার খণ্ডে আকবরের জীবনী, যার প্রতিটি খণ্ডে ৩০ বছর বিবৃত হবে কারণ, আবুল ফজলের ধারণা ছিল যে, আকবর ১২০ বছর বাঁচবেন। পঞ্চম খণ্ডটি হবে আইন-ই-আকবরী। কিন্তু প্রথম দুটি এবং পঞ্চম খণ্ডটি রচিত হয়। প্রথম খণ্ডে মনুষ্যজাতির ইতিহাস যা আবুল ফজল জানতেন, তা রচিত এবং তারই মধ্যে আদম (যাকে লেখক আকবরের প্রথম পিতৃপুরুষ বলে চিহ্নিত করেছেন) থেকে আকবরের জীবনের প্রথম ৩০ বছরের ইতিহাস আছে।
অর্থাৎ আকবরের রাজত্বের প্রথম ১৭ বছরের ইতিহাস। দ্বিতীয় খণ্ডে আকবরের রাজত্বের পরবর্তী ৩০ বছরের অর্থাৎ মোট ৪৭ বছরের ইতিহাস পাওয়া যায়। এর পরবর্তী খণ্ড রচিত হতে পারেনি কারণ আকবরের রাজত্বের ৪৭ বর্ষেই আবুল ফজল নিহত হন। আবুল ফজলের মৃত্যুর পর সম্ভবত মুহিব আলি খান নামে এক ব্যক্তি আকবরনামা-র পরবর্তী অংশ অর্থাৎ আকবরের মৃত্যুকাল পর্যন্ত সময়ের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেন।
আইন-ই-আকবরী পাঁচটি পর্বে বিভক্ত।
যেমন—
- (১) রাজকীয় তথা প্রাসাদ সংক্রান্ত,
- (২) সেনাবাহিনী এবং ২০০ থেকে ১০ হাজার পদবিশিষ্ট মনসবদার তথা জ্ঞানী ব্যক্তিদের তালিকা,
- (৩) ২০টি বিভিন্ন ক্যালেন্ডারের হিসাব, ফৌজদার ইত্যাদি পদের জন্য যোগ্যতা, জমির শ্রেণিবিভাগ, রাজস্বের তালিকা এবং আইন-ই-দহসালা,
- (৪) হিন্দুধর্ম সম্পর্কে নানা অভিমত এবং এটি গ্রন্থের সব থেকে দুর্বল অংশ,
- (৫) আকবরের কিছু বিখ্যাত বাণী এবং আবুল ফজলের আত্মজীবনী।
আইন-ই-আকবরী-র তথ্যের কোনও সূত্র নেই। অনেক ক্ষেত্রে স্বয়ং আকবরকেই উদ্ধৃত করা হয়েছে। আবার প্রয়োজনমতো সরকারি নথিকে বিকৃত করাও হয়েছে। মহজরনামা সম্পর্কে আবুল ফজল পুরোপুরি নীবর যদিও তাঁর পিতাই ছিলেন সেই দলিলের রচয়িতা। অবশ্য কোনও ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য লেখক কমপক্ষে ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করার এক পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। তবে অন্যের দেওয়া তথ্য বেমালুম আত্মসাৎ করার প্রবণতাও আছে। তথাপি আকবরের রাজত্বের এক দর্পণ হিসেবে বর্তমানকালেও আইন-ই-আকবরী অনন্য।
আকবরনামা কোনও কালপঞ্জী অনুসরণ না করে এক-একটি রাজত্বকে অনুসরণ করেছে। কিন্তু আকবরের রাজত্বের কাহিনী রচনার সময়ে লেখক বার্ষিক বিবরণী দিতে শুরু করেন। তবে এক্ষেত্রেও কালপঞ্জী অনুসৃত নয়। একটি ঘটনা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বহু ক্ষেত্রে হঠাৎ অন্য ঘটনা বিবৃত করার প্রবণতা আছে। সেজন্য হেরোডোটাসের রচনার মতো আকবরনামা অত চমকপ্রদ হয়ে ওঠেনি। বহু সময়ে যুদ্ধের একঘেঁয়ে বিবরণী, অশ্বের চরিত্র ও চেহারা নিয়ে বহু পৃষ্ঠা ব্যয়িত হয়েছে।
সরকারি যাবতীয় নথি, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির আবেদনপত্র, সরকারি ঘোষণা—এসব আবুল ফজল ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন। আবার কোনও ব্যক্তির ভাষ্য বা স্বপ্নকে পর্যন্ত নির্ভর করে তিনি লিখে গেছেন এবং যেখানেই বিপদের আশঙ্কা দেখেছেন সেখানেই আকবরকে উদ্ধৃত করে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। তাই অনুবাদক জ্যারেট লিখেছেন যে, কোন্ সুত্র থেকে আবুল ফজল তথ্য সংগ্রহ করছেন সে বিষয়ে তিনি আদৌ চিন্তিত ছিলেন না। পাতার পর পাতা অলবিরুনী থেকে তিনি নকল করে আইন-ই-আকবরী-র তৃতীয় খণ্ডে লিখে গেছেন।
হিন্দুদের প্রসঙ্গে তিনি বিশ্বনাথ কবিরাজের সাহিত্য দর্পণ-কে এবং হিন্দুদের সামাজিক তথা বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে মনুস্মৃতি-কে পুরো ব্যবহার করেছেন। আবার মুঘল প্রশাসন বিশেষত, কাবুল সম্পর্কে তিনি বাবরের তুজুক-কে ব্যবহার করেছেন। হুমায়ুন প্রসঙ্গে বায়াজিদ বায়াতের তাজকিয়া-ই-হুমায়ুন-ওয়া-আব্বর থেকে নকল করেছেন। কিন্তু সমস্যা যেটা, তা হল সুবিধামতো আবুল ফজল মূল রচনার শব্দের ওলট-পালট ঘটিয়ে নিজের ভাষায় তা লিখে গেছেন। মহজরনামা নিয়ে তিনি নীরব। কিন্তু একস্থানে মহজরের সংক্ষিপ্তসার লিখতে গিয়ে বলেছেন যে, (আকবরনামা-য়) বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে কোনও বিষয়ে মতবিরোধ হলে আকবরকেই সমস্ত মীমাংসার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। কিন্তু বদায়ুনী ও নিজামুদ্দীন আহমদ (তবাকত-ই-আকবরী) উভয়েই লিখেছেন যে, মহজর স্বাক্ষরকারীরা একমাত্র ইসলামের সুমি মতাবলম্বীদের মধ্যে বিভিন্ন ধারার মতে যদি অমিল দেখা যায় সেক্ষেত্রে আকবরকে নিজের পছন্দমতো মতটি গ্রহণের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। এটাও বলা হয় যে, আকবর কোনও ক্ষেত্রেই কোরানের ব্যাখ্যা ও নির্দেশ লঙ্ঘন করতে পারবেন না। এ প্রসঙ্গটিও আবুল ফজল এড়িয়ে গেছেন।
আকবরনামা-য় ঐতিহাসিক ঘটনার যে-বিবরণী হাজির করা হয়েছে তা এক নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে রচিত।
আকবরের রাজত্বের পূর্বেকার ঘটনাবলি এমনভাবে উপস্থাপিত যাদের দ্বারা আকবরকে অতিমানবিক হিসেবে বর্ণনা করতে সুবিধা হয়। এর ফলে ইতিহাস বিকৃত। ইতিহাস লিখতে গিয়ে কুশীলবদের মনোগত ইচ্ছা কী ছিল বা কী হতে পারত— এমনই সব ধারণাকে আবুল ফজল বেমালুম ইতিহাস বলে চালিয়ে দিয়েছেন। আকবরনামা অর্থে আকবর ও তাঁর পূর্বপুরুষ। ফলত তা এক সরকারি প্রচার দলিল ছাড়া কিছু নয়। তথাপি যে-অধ্যবসায় নিয়ে লেখক আকবরনামা ও আইন-ই-আকবরী লিখেছেন তাতে আকবরের রাজত্বকালের ৪৭ বর্ষ পর্যন্ত তা এক প্রামাণিক দলিল হিসেবে বর্তমানকালেও আদৃত।
তবে ঘটনাকে সাধারণ শ্রেণিভুক্ত করার মতো মারাত্মক দোষও লেখকের আছে। একটি বা দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করেই তিনি পুরো সামাজিক তথা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করেছেন। কারণ, আবুল ফজলের দৃষ্টিতে ইতিহাস অর্থে কিছু ঘটনার সমাহার ছাড়া কিছু নয়। একটি বিশেষ ঘটনা কোনও এক বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে কিন্তু পুরো বিষয়কে নয়। যেমন—আকবরের ধর্মমত সম্পর্কে, বিশেষত দীন-ইলাহী সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তিনি সম্রাটকে দৈবশক্তির অধিকারী বলেছেন। কিন্তু শাসকের নির্দিষ্ট গুণাবলি বিশ্লেষণকালে তিনি কোনোভাবেই কোনও শাসককে দৈবশক্তির অধিকারী হিসাবে দেখতে পাননি। একজন যোগ্য শাসকের আটটি চারিত্রিক গুণ থাকা উচিত বলে তিনি মনে করেছেন, যেগুলির মধ্যে দৈবশক্তি অনুপস্থিত। কিন্তু আকবর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বললেন যে, রাজত্ব করা দৈবকৃপা ছাড়া কিছুই নয়।
আবার বহু ক্ষেত্রে একই ঘটনার বিবরণী নানাভাবে তিনি দিয়েছেন। যেমন—হিমুর আক্রমণের সময়ে তারদি বেগের দিল্লি ত্যাগের ঘটনা। ঠিক এমনইভাবে লিখেছেন বৈরাম খানের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে। এসব ক্ষেত্রে তিনি অতীন্দ্রিয়বাদের দ্বারা চালিত, কোনও ঐতিহাসিক যুক্তিবাদের দ্বারা নয়। এমন উদাহরণ বহু আছে। যে-ঘটনার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেননি তাকেই ঈশ্বরের ইচ্ছাবা ঈশ্বরের ক্রোধ প্রভৃতির দ্বারা বর্ণনা করেছেন। যেমন রাজত্বের পঞ্চম বর্ষে কাশ্মীরে অশান্তির সংবাদ আকবরের ঐশ্বরিক কানে এসে পৌঁছলে মির্জা কারা বাহাদুরকে সেখানে পাঠানো হল। আবার স্থানে স্থানে গোলযোগ ও তাদের দমনকে বর্ণনা করেছেন সম্রাটের রাজকীয় অস্তিত্বের গুণ হিসেবে।
ড. হরবস মুখিয়ার মতে সমগ্র রচনায় আবুল ফজল দুটি ধারণার দ্বারা চালিত। প্রথমত, আকবর দৈবশক্তিধর পুরুষ এবং তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন মানুষের স্বাভাবিক কর্তব্য এবং দ্বিতীয়ত, আকবরের বিরুদ্ধে যাবতীয় বিদ্রোহ স্বাভাবিক নিয়মেই দমন হওয়ার যোগ্য এবং সেটিও ঈশ্বর নির্দেশিত।
আকবরকে লেখক ইহলোকে সাক্ষাৎ ঈশ্বর ছাড়া কিছুই বোঝেননি। তাই হুমায়ুনের মৃত্যু তাঁর কাছে শোকের ঘটনা নয়। ঈশ্বরের ইচ্ছায় আকবর সিংহাসনে বসতে পারলেন। তাই অন্য অনেক অন্যায় করেও, বিশ্বাসভঙ্গ করেও আকবরের প্রতি অনুগত থাকাই মানুষের একমাত্র কর্তব্য।
মুঘল বংশ তথ্য আকবরের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা ও ভক্তি থেকেই আকবরনামা-য় তিনি শের শাহের উত্থান ও সাফল্য নিয়ে বিশেষ কিছুই লেখেননি। শের শাহকে সর্বদা শের খান হিসেবে বর্ণনা করে একজন. বিদ্রোহী আফগান ছাড়া তিনি কিছুই মনে করেননি।
রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডকে তিনি অধিকাংশস্থলেই নৈতিক ক্রিয়া হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আকবরের ক্ষেত্রে সবই ভালো এবং আকবরের বিরোধিতার ক্ষেত্রে সবই মন্দ—এই ছিল তাঁর একমাত্র প্রতিপাদ্য। তবে মনে রাখতে হবে আকবরের নেতৃত্বে মুঘল সাম্রাজ্য যখন গড়ে উঠছে সেই সময়ে আবুল ফজল লেখনী ধারণ করেছিলেন। অতএব সাম্রাজ্যকে এক মজবুত আদর্শগত ভিত্তিদান করাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য এবং কালের বিচারে তিনি সফল।
তবে তাঁর পূর্বসূরিদের তুলনায় আবুল ফজলের লেখনী অন্য জাতের ছিল। পূর্ববর্তী প্রতিবেদকরা সমকালীন শাসক বা পৃষ্ঠপোষকদের গুণকীর্তন ছাড়া আর কিছুই করেননি। সেক্ষেত্রে আবুল ফজল যথেষ্ট বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির চিহ্ন রেখেছেন। প্রথমত, আকবরনামা-র ভাষা অত্যন্ত প্রাঞ্জল এবং দ্বিতীয়ত মধ্যযুগীয় অন্য লেখকদের মতো যত্রতত্র কাব্যকৃতির কোনও চেষ্টা তিনি করেননি, আকবরনামা তথা আইন-ই আকবরী-র অনুবাদক বেভারিজ আবুল ফজলকে সৎ প্রতিবেদক হিসেবেই গণ্য করেছেন, তবে হেরোডোটাসের মতো রচনাশৈলী তাঁর ছিল না।
আবার বদায়ুনীর মতো কঠোর ভাষাও প্রয়োগ তিনি করেননি। সম্ভবত এই কারণেই পরবর্তীকালের লেখকরা আকবরনামা-র রচনাশৈলীর দ্বারা প্রভাবিত যদিও আইন-ই-আকবরী-র মতো গবেষণাধর্মী দ্বিতীয় কোনও গ্রন্থ পাওয়া যায় না। আবুল ফজল যে-সময়কালে রচনা করছেন সেই সময়ে সাম্রাজ্যে ধর্মীয় মানসিকতা ও পরিবেশ নানাভাবে উদ্বেলিত। কিন্তু তাঁর রচনার মধ্যে কোনোভাবেই ধর্মীয় মৌলবাদের ছোঁয়া নেই। এমনকি সমসাময়িক প্রথা অনুযায়ী তাঁর গ্রন্থ আল্লাহ্ বা হজরত মহম্মদকে বন্দনা করে শুরু হয়নি। এটি কম আধুনিকতার পরিচয় নয়। আবুল ফজলের রচনায় কোথাও ইসলামকে অন্যান্য ধর্মমত অপেক্ষা উন্নত বলে দাবি করার প্রবণতাও নেই। তাঁর মুখ্য প্রতিপাদ্য ছিল আকবরের জয়গান করা। তাই বেভারিজ তাঁকে নির্লজ্জ চাটুকার হিসেবেই গণ্য করেছেন।
সারসংক্ষেপ
ধর্ম সম্পর্কে তাঁর উদার মনোভাব, আইন-ই-আকবরি-র হিন্দুস্থানের জনগণ শিরোনামা একটি অনুচ্ছেদে তুলে ধরা হয়েছে। নিম্নোক্তরূপে অনুচ্ছেদের প্রধান লক্ষ্যবস্তুর সারসংক্ষেপ করা যায় :
১। হিন্দু মুসলমানের ধর্মীয় বৈরী ও তিক্ততার প্রধান উৎস এই বিশ্বাস যে হিন্দুরা শির্ক (Shirk)-এ প্রবৃত্ত হয়, অর্থাৎ তারা সাকার মনুষ্য ও তাদের মূর্তির সাথে দেবগুণ সংশ্লিষ্ট করে। আবুল ফজলের দৃঢ়োক্তি যে হিন্দুদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ভিত্তিহীন ছিল। সযত্ন পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে হিন্দুরা একেশ্বর ধারণার অনুগামী।
২। এ সত্ত্বেও, ভুল ধারণার শিকড় গভীরে প্রোথিত, যা তিক্ত শত্রুতা এমনকি রক্তপাতে পরিণতি লাভ করেছে।
৩। ভুল ধারণার উৎস বহু।
(ক) পরস্পরের ভাষা ও চিন্তাধারা সম্পর্কে পূর্ণ অজ্ঞতা।
(খ) গবেষণা ও অনুসন্ধানের পথে অন্তর্নিহিত সত্যের উপলব্ধিতে সংখ্যাগুরুর অনিচ্ছা।
(গ) বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করে অগ্রসর হওয়ার স্থানে প্রতিষ্ঠিত প্রথাবিধির সাধারণ স্বীকৃতি, কারণ সাধারণের বিশ্বাস যে সযত্ন অনুসন্ধানে লব্ধ জ্ঞান কুফূর (kufri) তুল্য।
(ঘ) বিভিন্ন ধর্মের বিধান ও প্রাজ্ঞদের সহানুভূতি ও সমঝোতার পরিবেশে মতবিনিময় ও গুণাগুণ বিচার করে বিতর্কিত বিষয় বিচারের উপযোগী মিলনক্ষেত্রের অভাব।
(ঙ) উদ্যোগ গ্রহণ ও স্বাধীন মতবিনিময়ের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে সুস্পষ্টরূপে সত্য জ্ঞাপনে জ্ঞানীগুণীদের সক্ষম করতে, এমনকি প্রথম নৃপতির পর্যন্ত ব্যর্থতা।
(চ) ইতরামি ও বর্বর আচরণ থেকে নিজেদের নিরক্ত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সুপ্রবৃত্তি ও জ্ঞান জনগণের ছিল না। তারা অপরের ধর্মে হস্তক্ষেপ, তাদের হত্যা ও অসম্মান করেছে। ধর্মীয় উৎপীড়ন যে অযৌক্তিক ও নিষ্ফল সেটা তারা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিল। বিরোধীরা যদি ভুল পথে চলত, তাহলেও অজ্ঞতার কারণেই ঘৃণা ও রক্তপাতের পরিবর্তে, সুবিবেচনা ও সহানুভূতি তাদের প্রাপ্য ছিল।