You are currently viewing শাসক হিসাবে খলিফা হারুনুর রশীদের কৃতিত্ব আলোচনা করো।
শাসক হিসাবে খলিফা হারুনুর রশীদের কৃতিত্ব আলোচনা করো।

শাসক হিসাবে খলিফা হারুনুর রশীদের কৃতিত্ব আলোচনা করো।

প্রশ্ন : আব্বাসী খলীফাদের মধ্যে হারুনুর রশীদের শানকাল এত প্রসিদ্ধ কেন ? অথবা, ইতিহাসে খলীফা হারুনুর রশীদের এত নামডাক কেন ? বিস্তারিতআলোচনা কর।
শাসক হিসাবে খলিফা হারুনের কৃতিত্ব আলোচনা করো।

খলীফা হারুনুর রশীদ (সংক্ষিপ্ত)

  • ভূমিকা
  • সাম্য ও সম্প্রীতি রক্ষা
  • বিদ্রোহ দমন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা
  • প্রজাপালন ও ন্যায়-নিষ্ঠা কায়েম
  • জনহিতকর কার্য
  • বাগদাদের ঐশদর্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার
  • উপসংহার

খলীফা হারুনুর রশীদ (বিস্তারিত)

  • সিংহাসন লাভ
  • হারুনের শ্রেষ্ঠত্ব
  • সমরকুশলী
  • বাগদাদের ঐশ্বর্য
  • বিদ্যোৎসাহী হিসেবে হারুন
  • কাব্য ও সাহিত্য ধর্ম
  • ধর্ম
  • কাগজের কল প্রতিষ্ঠা
  • উপসংহার

উত্তর :- (সংক্ষিপ্ত)

ভূমিকা :- খলীফা হারুনুর রশীদের শাসনকাল “আব্বাসী আমলের স্বর্ণযুগ” নামে পরিচিত। ৭৮৬ খ্রি: থেকে ৮০৯ খ্রি: পর্যন্ত দীর্ঘ তেইশ

বছরের শাসনামলে দেশের উন্নতি, শাসন ব্যবস্থায় অপূর্ব সাফল্য, সম্প্রীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার, বাগদাদের ঐশ্চর্য ও সৌন্দর্য

বৃদ্ধি এবং জনগণের যে পরিমাণ কল্যাণ সাধিত হয়েছিল, আব্বাসীয় অন্য কোনো খলীফার আমলে তা সম্ভব হয়নি। তাই আব্বাসীয় খলীফাদের

মধ্যে হারুনুর রশীদের শাসনকাল এবং তাঁর নামডাক পৃথিবীর ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। নিচে তার বিস্তারিত আলোচনা করা হল।

সাম্য ও সম্প্রীতি রক্ষা :- খলীফা হারুনুর রশীদ ছিলেন সাম্যের প্রতীক। তাঁর শাসনামলে জাতি-ধর্ম বির্নিশেষে সকল মানুষের মধ্যে গড়ে উঠেছিল।

সাম্য-সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ। গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব ও পারস্পরিক ভেদাভেদ ভুলে প্রজাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অনাবিল শান্তি ও নিরাপত্তা।

তাঁর যুগে বাঘে ও ছাগলে যেন একই ঘাটে পানি পান করত।বিদ্রোহ দমন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা :- খলীফা হাদীর মৃত্যুর পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে

খারিজীদের বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। খলীফা হারুন তাদের কঠোর হস্তে দমন করেন।

দেশদ্রোহী ও দুর্বৃত্তদের শায়েস্তা করে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন।

বিদ্রোহ দমন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা :- খলীফা হাদীর মৃত্যুর পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে খারিজীদের বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

খলীফা হারুন তাদের কঠোর হস্তে দমন করেন। দেশদ্রোহী ও দুর্বৃত্তদের শায়েস্তা করে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন।

প্রজাপালন ও ন্যায়-নিষ্ঠা কায়েম :- খলীফা হারুনুর রশীদ প্রজাদের সুখ-দুঃখ জানার জন্য এবং তাদের হাল-জকিকত স্বচক্ষে দেখার

জন্য প্রায় দিনের বেলায় ছদ্মবেশে রাজপথে বেরিয়ে পড়তেন। বাজারে জিনিস পত্রের মূল্য যাচাই করার জন্য দোকানের সামলনে দাঁড়াতেন।

নিপীড়িত ও দুর্দশাগ্রস্তদের দুঃখমোচনের জন্য রাত্রি বেলায় বাগদাদের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। ফরিয়াদীর ফরিয়াদ শুনতেন।

বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করতেন। ধনী-গরিব সকলের প্রতি সমান বিচার করতেন। যার কারণে আজও তিনি সকলের মাঝে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

জনহিতকর কার্য :- খলীফা হারুনুর রশিদ প্রজাদের সুখ-সুবিধার জন্য অনেক জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করেন।

যাতায়াতের সুবিধার জন্য রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মাণ করেন। কৃষিকার্যের উন্নতির জন্য নহর ও খাল খনন করেন এবং তাতে বাঁধ নির্মাণ

করে সেচ ব্যবস্থা চালু করেন। স্কুল, কলেজ, মন্তব-মাদ্রাসা, মসজিদ, সরাইখানা শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে ব্যাপকউন্নতি সাধিত হয়।

খলীফার মহানুভবতা ও দানশীলতায় দেশ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।

বাগদাদের ঐশদর্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার :- খলীফা হারুনুর রশীদের শাসনামলে বাগদাদ বিশ্বের সেরা নগরী হিসাবে খ্যাতি অর্জন করে।

শিল্প -সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের দিক দিয়ে সারা পৃথিবীতে তার কোনো জুড়ি ছিলনা। বাগদাদের সুরম্য অট্টালিকা, সু-শোভিত রাজপ্রাসাদ,

জাঁকজমক রাজদরবার, হেরেম ও সুসজ্জিত রানী মহল। খলীফা হারুন বাগদাদ নগরীকে রূপ কথায় স্বপ্নপুরীতে পরিণত করেছিলেন।

বাগদাদ ছিল সেই যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র। সেখানে বহু কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও চিকিৎসকের আবির্ভাব ঘটে। চিকিৎসা

বিজ্ঞানে প্রচুর সাফলা হয় এবং শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সভ্যতায় ব্যাপক উন্নতি ঘটে। ফলে তাঁর শাসনকাল সারা বিশ্বের মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করে

এবং তার নামডাক চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

উপসংহার :- হারুনুর রশীদ ছিলেন নবম শতাব্দীর শান্তির দূত; আব্বাসী বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ খলীফা। ন্যায়-নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠায় এবং ধার্মীকতায়

তিনি সারা বিশ্বে প্রসিদ্ধ ছিলেন এবং আরব্য উপন্যায় “আলিফ লায়লার” বদৌলতে আজও তিনি সকলের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

খলীফা হারুনুর রশীদ (বিস্তারিত)

সিংহাসন লাভ – হাদীর মৃত্যুর পর হারুন-অর-রশীদ পঁচিশ বছর বয়সে বাগদাদের সিংহাসনে আরোহণ করেন (৭৮৬ খ্রিঃ)।

তাঁর সুদীর্ঘ রাজত্বকাল বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসলামের ইতিহাসকে গৌরবমণ্ডিত করেছে। শাসনব্যবস্থার সাফল্য, বাগদাদের ঐশ্বর্য, জনগণের

কল্যাণ সাধন ইত্যাদি তাঁকে আরব্যোপন্যাসের নায়ক হিসেবে মহিমান্বিত করে রেখেছে।

সিংহাসনে আরোহণের পর হারুন-অর-রশীদ তাঁর মাতা খায়জুরানকে সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা দেন। হারুনের বাল্যশিক্ষক

খালিদ-বিন-বার্মাকীর পুত্র ইয়াহ্ইয়া খায়জুরানের পৃষ্ঠপোষকতায় খলিফার উপদেষ্টা ও উজির নিযুক্ত হলেন। হারুন সর্বদা তাঁর

উপদেশ ও পরামর্শ শ্রদ্ধাভরে মেনে চলতেন। ইয়াহ্ইয়ার পুত্র ফজল এবং জাফরও উচ্চরাজপদ লাভ কররেন।

হারুন-অর-রশিদের রাজত্বকালে বার্মাকারী সাম্রাজ্য যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন।

হারুনের শ্রেষ্ঠত্ব – আরব্যোপন্যাসের সহস্র রজনীর নায়ক হারুন-অর-রশীদ আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ

নরপতিগণের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। ইতিহাস ও উপাখ্যান তাঁকে এড প্রসিদ্ধ করে রেখেছে যে, পরবর্তীকালের লেখকগণ আব্বাসীয়

খিলাফতের স্বর্ণযুগ হিসেবে তাঁর রাজত্বকালকে গ্রহণ করেছেন। সমরনৈপুণ্যে, অভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানে, জনহিতকর কার্যে,

জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভে তিনি শুধু আব্বাসীয় ইতিহাসেই নন, পৃথিবীর ইতিহাসেও অমর হয়ে রয়েছেন।

পি. কে. হিট্টি বলেন, “নবম শতাব্দীর শুরুতে দু’ঞ্জন বিশ্ববিখ্যাত নৃপতির নাম ইতিহাসের দিগন্তে দেখা যায়- পাশ্চাতো শার্লিমেন, আর প্রাচ্যে

হারুন-অর-রশীদ। এ দু’জনের মধ্যে হারুন নিঃসন্দেহে অধিকতর শক্তিশালী ও উন্নতর সংস্কৃতির অধিকারী ছিলেন।” ঐতিহাসিক খোদাবক্‌স বলেন,

পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের খলিফাদের ইতিহাসে হারুন-অর-রশীদ অপ্রতিদ্বন্দ্বী শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন। ঐতিহাসিক গীবন তাঁকে আব্বাসীয় বংশের সর্বাপেক্ষা প্রতিভাবান খলিফা বলে অভিহিত করেছেন।

সমরকুশলীখলিফা হারুন সিংহাসনে আরোহণের পর কঠোর হস্তে বিভিন্ন বিদ্রোহ দমন করে সাম্রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন।

অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য তিনি কখনও কখনও স্বয়ং সৈন্য পরিচালনা করে দক্ষতা ও রণকুশলতার পরিচয় দেন।

তিনি বাইজানটাইন সম্রাটের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করে তাঁকে সন্ধি স্থাপনে বাধ্য করেন। বাইজানটাইন সম্রাটের বিরুদ্ধে বারবার সৈন্য

পরিচালনা এবং তাঁকে বারবার পরাজিত করায় একদিকে যেমন হারুনের সামরিক দক্ষতা ও রণকুশলতার পরিচয় পাওয়া যায়,

অন্যদিকে তেমনি পুনঃপুন ক্ষমা করায় তাঁর অদূরদর্শিতারও পরিচয় বহন করে।

বাগদাদের ঐশ্বর্য – খলিফা হারুন-অর-রশীদের রাজত্বকালে বার্গদাদ বিশ্বের সেরা নগরীর খ্যাতি অর্জন করেছিল। ঐতিহাসিক খতিবের মতে,

“সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের দিক দিয়ে সারা জাহানে এ নগরীর কোন জুড়ি ছিল না।” সুরম্য অট্টালিকা, জমকালো রাজপ্রাসাদ, বিলাসবহুল হেরেম,

আড়ম্বরপূর্ণ দরবার, নয়নাভিরাম মিলনায়তন প্রভৃতি বাগদাদকে রূপকথার স্বপ্নপুরীতে পরিণত করেছিল।” এ স্বপ্নপুরী বাগদাদের অপরূপ

শোভা ও সৌন্দর্য অসংখ্য কবি ও সাহিত্যিকের রচনাকার্যে প্রেরণা যুগিয়েছে। সে আমলে সমগ্র পৃথিবীতে বাগদাদের সমকক্ষ নগর আর একটি

খুঁজে পাওয়া যায় না। এ রাজত্বকালের গৌরব বৃদ্ধিতে সম্রাজ্ঞী যুবায়দা ও খলিফার ভগ্নী উপাহার ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য ছিল। তাঁদের উদ্ভাবিত

বেশভূষা ও সাজসজ্জা দেশ-বিদেশের সৌন্দর্যানুরাগীদের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল।

এ যুগে বাগদাদের পণ্যশিল্প ছিল বিশ্ববিখ্যাত। সমুদ্র বন্দর হিসেবে বাগদাদের আলাদা গুরুত্ব ছিল । এর কয়েক মাইলব্যাপী সুদীর্ঘ পোতাশ্রয় জুড়ে

শত শত জাহাজ শোভা পেত। এগুলো যুদ্ধ ও নৌ-বিহারে ব্যবহৃত হত। বাগদাদের বাজারসমূহে চীন হতে চীনামাটির বাসন, সিল্কের কাপড় ও মুখোশ,

ভারত এবং মালয় হতে মশলা, খনিজ পদার্থ ও রং, মধ্য এশিয়ার তুর্কীস্তান হতে রুবী, নীলবর্ণের মূল্যবান পাথর, উন্নত বস্ত্র এবং ক্রীতদাস,

স্কান্ডেনেভিয়া ও রাশিয়া হতে মধু, ভেড়ার লোম ও দাস, পূর্ব আফ্রিকা হতে হাতীর দাঁত ও কাফ্রী ক্রীতদাস আসত। আবার সাম্রাজ্যের

অন্তর্ভুক প্রদেশগুলো হতেও স্থল ও জলপথে দ্রব্যসামগ্রী এসে পৌঁছাড়। এগুলোর মধ্যে মিশর হতে চাল, খাদ্যশস্য ও লিনেন কাপড়,

সিরিয়া হতে কাচ, ধাতবসামগ্রী ও ফলমূল, আরব হতে কিংখাব, মুক্তা ও হাতিয়ার এবং পারস্য হতে রেশমজাত সামগ্রী, সুগন্ধী ও সবজি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

তিনটি নৌকার সেতুর সাহায্যে নগরীর পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করা হত। বাগদাদ ও অন্যান্য রপ্তানি এলাকা হতে আরব

বণিকগণ দূরপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং আফ্রিকার পথে পাড়ি জমাতেন। তাঁদের সাথে থাকত স্বর্ণালংকার, বস্ত্র, মশলা ও কাচের পুঁতি। সম্প্রতি

ফিনল্যান্ড, সুইডেন, জার্মানি এবং রাশিয়ার বিভিন্ন স্থানে আরবীয় মুদ্রার যে ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে, তা হতে সে আমলের দুনিয়াব্যাপী

মুসলিম বাণিজ্যের সংবাদ অনুমান করা যায়। আরব বণিকগণ বিভিন্ন দেশের সাথে ব্যবসায়-বাণিজ্য করে বাণিজ্যলব্ধ সম্পদ দ্বারা বাগদাদের

ঐশ্বর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল। ঐতিহাসিক পি. কে. হিটি বলেন, “ইতিহাস ও উপাখ্যানে বর্ণিত বাগদাদের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলো

হারুন-অর-রশীদের রাজত্বকালেই পরিলক্ষিত হয়।” হিটি আরও বলেন, “সে যুগে বাগদাদ ছিল সমগ্র বিশ্বে একটি অদ্বিতীয় শহর।”

হারুনের সাথে বাগদাদের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে রয়েছে। হারুন ব্যতীত আরব্যোপন্যাস যেমন অসম্পূর্ণ ও অজ্ঞাত থাকত,

বাগদাদ ছাড়া হারুনও তেমনি অসম্পূর্ণ থাকতেন।

বিদ্যোৎসাহী হিসেবে হারুন – হারুন-অর-রশীদের রাজত্বকাল বিপুল ঐশ্বর্য ও উন্নতমানের জীবনযাত্রার জন্য শুধু বিখ্যাত নয়,

জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এটা সমধিক উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। তাঁর রাজত্বকাল মধ্যযুগের ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশের এক বিরাট সাক্ষ্য।

খলিফা জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংগীত প্রভৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং এগুলোর উন্নতির জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। আমীর আলী বলেন,

“তিনিই সর্বপ্রথম সংগীতকলাকে মহান পেশায় উন্নীত করেন এবং সাহিত্য ও বিজ্ঞানের মত এর জন্যও মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করেন।”

কাব্য ও সাহিত্য ধর্ম – তাঁর দরবার ছিল সাম্রাজ্যের জ্ঞানী-গুণীর মিলনকেন্দ্র। হারুনের পৃষ্ঠপোষকতায় আকৃষ্ট হয়ে পৃথিবীর নানা দিক

হতে বহু কবি, দার্শনিক, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক ও গায়ক তাঁর দরবারে এসে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করতেন। ঐতিহাসিক ওয়াকিদী,

বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ আসমায়ী, শফি ও আবদুল্লাহ বিন ইদ্রিস, চিকিৎসক জিব্রিল, সঙ্গীতজ্ঞ মসুলী, কবি আবু নুয়াস ও আবুল আতাহিয়া,

অনুবাদক হাজ্জাজ, পণ্ডিত শাফেয়ী, ইমাম আবু ইউসুফ প্রমুখ মনীষী তাঁর রাজদরবারকে অলঙ্কৃত করেছিলেন। খলিফা নিজেও কবি ছিলেন।

তিনি তাঁর প্রেমিকা রোমান রমণী হেলেনের উদ্দেশ্যে বহু কবিতা রচনা করেন। ইবনে খালদুন বলেন, “রশীদ একমাত্র কৃপণতা ব্যতীত

অন্য সকল বিষয়ে তাঁর পিতামহের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন; কারণ কোন খলিফাই উদারতা ও বদান্যতায় তাঁকে অতিক্রম করতে পারেন নি।”

তিনি নিজে কবি হওয়ায় কবিদের প্রতি খুব সদয় ছিলেন। তিনি গানও ভালবাসতেন। ইব্রাহীম মসুলী তাঁর সময়ের প্রসিদ্ধ গায়ক ছিলেন।

ইব্রাহীম মসুলীর ঋণে খলিফা হারুন এতদূর মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তাকে ১৫,০০০ দিরহাম পুরস্কার ছাড়াও প্রতি মাসে নিয়মিত ১০,০০০ দিরহাম

ভাতা দিতেন। খলিফার পৃষ্ঠপোষকতায় ও তাঁর পরিচালনায় আরবি সঙ্গীতের যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধিত হয়। খলিফা ইসলামী আইন

সম্বন্ধে ধর্মবিদ ও পণ্ডিতদের সাথে আলাপ-আলোচনা করতে ভালবাসতেন।

ধর্ম হারুনের প্রধান কাজী আবু ইউসুফের নেতৃত্বে এ সময় সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত হানাফী স্কুল চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। আমীর আলী বলেন,

“হানাফী ধর্মবিধি আবু হানিফার নামানুসারে, নামকরণ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এটা রশীদের প্রধান বিচারপতির (আবু ইউসুফ) সৃষ্টি বিশেষ।”

বিদেশী ভাষা হতে বিজ্ঞানের পুস্তকাদি আরবিতে অনুবাদ করার জন্য তাঁর পিতামহ মনসুর যে বিভাগ বুলেছিলেন হারুন-অর-রশীদ

তার কলেবর বর্ধিত করেন। তাঁর চেষ্টায় বিভিন্ন ভাষার বহু মূল্যবান গ্রন্থ আরবি ভাষায় অনূদিত হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক নতুন দ্বার উদ্ঘাটিত হয়।

কাগজের কল প্রতিষ্ঠা – জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের জন্য খলিফার খোরাসানের শাসনকর্তা ফজল-বিন-ইয়াহইয়া বার্মাকীর অনুরোধে

৭৯৪-৯৫ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে কাগজের কল (Paper mill) প্রতিষ্ঠিত হয়। অধ্যাপক হিটি বলেন, “এ যুগ পৃথিবীর ইতিহাসকে যে কারণে

গৌরবোজ্জ্বল করেছে তা হলো এই যে, এ আমলে ইসলামের ইতিহাসে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বাপেক্ষা অধিক উৎকর্ষ সাধিত হয়।”

উপসংহার খলিফা হারুনের দরবার সে যুগে সর্বাপেক্ষা আড়ম্বরপূর্ণ ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল হতে জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিগণ এ দরবারে

সমবেত হতেন এবং তাঁর পৃষ্টপোষকতা লাভ করতেন। রূপকথার সম্রাট ও ইতিহাসের রোমাঞ্চকর ব্যক্তি হারুন-অর-রশীদ ছিলেন

অনন্যসাধারণ খলিফা। তাঁকে কেন্দ্র করে আরব্যোপন্যাস বা ‘এক সহস্র ও এক রজনীর’ কাহিনী লিখিত হয়। এতে তাঁর নৈশভ্রমণের কথা

লিপিবন্ধ আছে। আরব্যোপন্যাসের গুরুত্ব সম্বন্ধে গীবন বলেন, “আরব্যোপন্যাস ব্যতীত ‘রবিনসন ক্রুসো’ এবং সম্ভবত গ্যালিভারের ভ্রমণ

কাহিনী রচিত হত না। এসব বিচারে বলা যায় যে, হারুন-অর-রশীদের রাজত্বকালে মুসলিম সাম্রাজ্য গৌরবের স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করে।

একপ সমৃদ্ধি, সভ্যতা ও কৃষ্টি ইতঃপূর্বে দেখা যায় নি।

Leave a Reply