মুঘল সাম্রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রের পরিচয়
মুঘল সাম্রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রের পরিচয়

মুঘল সাম্রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রের পরিচয়

কৃষিক্ষেত্রের পরিচয়

কৃষি উৎপাদন

কৃষিভিত্তিক শিল্প

জলসেচ

বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতিকে নিয়ে গঠিত ভারতকে শাসন করার জন্য যে রাজস্ব কাঠামোর প্রয়োজন তা শের শাহ ভালোই বুঝেছিলেন। আকবর সেই ব্যবস্থাকেই যুগোপযোগী করে স্থায়ী রূপ দেন। জমির জরিপ ও দীর্ঘস্থায়ী রাজস্ব আদায় কাঠামোর এক রূপরেখা আকবর তৈরি করেন ও সফলও হন। রাজস্ব বৃদ্ধির তাগিদে নতুন নতুন অঞ্চলে কৃষির বিস্তার ঘটানো, নগদে রাজস্ব আদায়ের ফলে গ্রামীণ অর্থব্যবস্থায় মুদ্রার প্রচলন বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যের বাণিজ্যিকীকরণ—এসবই সাম্রাজ্যের সজীবতার লক্ষণ। এই ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল বলেই ‘আমলাতন্ত্রকে দক্ষ রাখা সম্ভব হয়েছিল।

কৃষিক্ষেত্রের পরিচয়

মুঘল রাজত্বে ভৌগোলিক বিচারে কৃষিক্ষেত্রগুলির অবস্থান ও পরিমাণ নিয়ে নানারকম মত আছে। ডব্লু এইচ মোরল্যান্ড থেকে শুরু করে ড. ইরফান হাবিব এবং তাঁর উত্তরসূরিস্বরূপ ড. শিরিন মুসভি প্রমুখ ঐতিহাসিক এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন। প্রাচীনকাল থেকেই কৃষি ও কৃষিজ উৎপাদন ভারতীয় শাসককুলের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

কৃষির বিকাশ ঘটার অর্থ রাজস্বের যেমন বৃদ্ধি তেমনি বিপুল সংখ্যক অভিজাতশ্রেণীর ভরণপোষণ। অতএব কৃষির বিকাশে প্রত্যেক শাসকেরই বিশেষ নজর ছিল। মুঘল সম্রাটরা তার ব্যতিক্রম নন।

কিন্তু ঠিক কত পরিমাণ জমিকে কৃষির আওতায় আনা সম্ভব হয়েছিল এ বিষয়ে পরস্পর-বিরোধী তথ্য পাওয়া যায়। আকবরের রাজত্বকাল সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরী-তে এবং আরিফ কান্দহারী তাঁর তবাকাত-ই-আকবরী-তে মন্তব্য করেছেন যে সমগ্র সাম্রাজ্যই ছিল কৃষির উপযোগী। কিন্তু পরবর্তীকালে এই সময়ের ইতিহাস লিখতে বসে সুজন রাই তাঁর ইকবালনামায় মন্তব্য করেন যে, সাম্রাজ্যের মোট জমির মাত্র তিন ভাগই কৃষিকাজের উপযুক্ত ছিল।

মুঘল রাজত্বের দীর্ঘ দুশো বছরের ইতিহাসে কৃষিক্ষেত্র সম্পর্কে কার্যত দুটি প্রতিবেদন পাওয়া যায় এবং সেগুলিও যে সম্পূর্ণ, তা বলা চলে না। আইন-ই-আকবরী-তে আকবরের রাজত্বের চল্লিশ বর্ষে সাম্রাজ্যের মোট ১২টি সুবা-র প্রতিটি গ্রাম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আছে। কিন্তু বাংলা, কাশ্মীর এবং থট্টা সম্পর্কে কোনও তথ্য নেই। দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি হল ১৭৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে রাই চতুরমন রচিত চহার গুলশন যা আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে সমগ্র সাম্রাজ্যের প্রতিটি সরকার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে।

ড. হাবিব আইন-ই-আকবরী-তে দেওয়া জমির পরিসংখ্যান বোঝাতে বিঘা-ই-ইলাহী মাপের আধুনিক পরিমাণ বলেছেন ০.২৪ হেক্টর। মোরল্যান্ড মনে করেন যে, মুঘল রাজত্বে গ্রামের জমির যা পরিসংখ্যান পাওয়া যায় সেইসব জমিই ছিল কৃষিযোগ্য। অবশ্য ড: হাবিবের মতে সমকালীন তথ্য যে শুধুমাত্র কৃষিক্ষেত্রের পরিমাণ বোঝায় তা নয়, কোন জমিতে চাষ হতে পারে সেটিও বোঝায়। এই সূত্রে প্রয়োজনে বনজঙ্গল, নদীনালা, পাহাড় সবই গ্রামের কৃষিক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হতে দেখা যায়।

এই তথ্যের ভিত্তিতে ড. হাবিব মুঘল রাজত্বে কৃষিক্ষেত্র হিসেবে তিন শ্রেণীর জমিকে চিহ্নিত করেছেন। যেমন – (১) যে জমিতে চাষ হচ্ছে, (২) বর্তমানে যে জমিতে চাষ হচ্ছে না এবং (৩) পতিত জমি।

মুঘল রাজত্বে জনবসতির বিন্যাসের নিরিখেও কৃষিক্ষেত্রগুলির অস্তিত্ব বোঝার চেষ্টা হয়েছে। চহার গুলশন-কে অনুসরণ করে বলা হয় যে, আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে কামরূপে (অর্থাৎ বর্তমান অসমে ) ১,০৯,৯২৩ টি গ্রাম ছিল এবং সেই হিসেবে ওই প্রমাণ গ্রাম জুড়ে ছিল কৃষিখেত। অবশ্য এ জাতীয় তথ্য সর্বত্র নেই।

আইন-ই-আকবরী-কে অনুসরণ করে হেনরি ব্লখম্যান আকবরের রাজত্বকালে বাংলায় এবং পরবর্তী সময়ে বাংলার জনবসতির এলাকা ও কৃষিখেতের এক বিবরণী দিয়েছেন। সুন্দরবন পর্যন্ত বাংলার বিশাল এলাকার চাষ হত। চট্টগ্রাম মগদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ায় এবং শ্রীহট্টে জঙ্গল থাকায় মনুষ্য বসতি ছিল কম। ১৬৬৫-৬৬ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে বর্তমান বরিশালে নতুন করে বসতির বিস্তার ঘটায় চাষও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ওড়িশা সম্পর্কে তথ্যভাণ্ডার খুবই অপ্রতুল যদিও ড. হাবিবকৃত মুঘল ভারতের মানচিত্রে দেখা যায় যে ওড়িশার ব্যাপক এলাকা ছিল অরণ্যবেষ্টিত।

বিহারের কৃষিখেতের পরিমাণ হিসাব করতে গিয়ে ড. হাবিব দেখিয়েছেন যে, আওরঙ্গজেবের রাজত্বে মোটামুটিভাবে আকবরের রাজত্ব অপেক্ষা কৃষিখেতের আয়তন তিনগুণ বৃদ্ধি পায়। অবশ্যই বিহারে কৃষিখেতের পরিমাণ অনেক বেশি ছিল, কারণ মুঘলদের রাজস্ব সংক্রান্ত নথিগুলি মূলত গাঙ্গেয় উপত্যকা সংক্রান্ত। অভ্যন্তরের বহু অঞ্চলে মুঘলরা কোনও সময়ে জরিপ ইত্যাদির চেষ্টা করেনি। অবশ্য উত্তরে তরাই ছিল জঙ্গলাকীর্ণ।

বিহারের পশ্চিমেই আছে গঙ্গাবিধৌত এলাহাবাদ এবং অযোধ্যার মতো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দুটি সুবা। গঙ্গানদীর দুই তীর ধরে এলাহাবাদ যা গঙ্গা-যমুনা তথা গঙ্গা-ঘর্ঘরা দোয়াবে বিস্তৃত। এর লাগোয়া অঞ্চল আছে যার পূর্বদিকে গগুক নদী এবং পশ্চিমে গঙ্গা। এই অঞ্চলগুলি ভারতের শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত হলেও আকবরের রাজত্বে তাদের কতটা জরিপ হয়েছিল সে বিষয়ে তথ্য নেই। তবে জাবত ব্যবস্থা এখানে চালু ছিল এবং আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে এই অঞ্চলের জরিপের কাজ সম্পন্ন হয়।

আনুপাতিক হারে এলাহাবাদের তুলনায় অযোধ্যায় জনবসতিপূর্ণ অঞ্চল কম থাকায় কৃষিখেতও কম ছিল বলে অনুমিত হয়। সরকার গোরক্ষপুর ছিল তরাই অরণ্যের অন্তর্গত। অর্থাৎ সপ্তদশ শতকের শেষভাগেও তৎকালীন গোরক্ষপুরে (যার অন্তর্গত ছিল গোরক্ষপুর, দেওরিয়া ও বস্তি জেলাগুলি) জনবসতি ছিল নগণ্য। এমনই অরণ্য বিস্তৃত ছিল ঘর্ঘরা নদীর দক্ষিণে যা বর্তমানকালের আজমগড় জেলার পূর্বাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। পিটার মান্ডিকে উদ্ধৃত করে ড. হাবিব লিখেছেন যে, এলাহাবাদ ও বেনারসের মধ্যবর্তী ভূখণ্ড জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। ফলত জনবসতি ও চাষাবাদের কোনও সম্ভাবনা ছিল না।

সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল আগ্রা সুবা যা দোয়াব-এর অন্তর্গত। আবার যমুনা ও চম্বল নদীর মধ্যবর্তী ক্ষেত্রেও আগ্রা। ড. হাবিবের মতে, আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে এই সুবার সমস্ত গ্রামেই জাবত ব্যবস্থা চালু ছিল। মোরল্যান্ড যা তথ্য দিয়েছেন এবং বিংশ শতকের গোড়ায় ওই অঞ্চলে ইংরেজ রাজস্ব কর্মচারীরা যে নথি প্রস্তুত করেছিলেন তাদের তুলনা করলে দেখা যায় যে ১৯০৯-১০ খ্রিস্টাব্দের পূর্ববর্তী ১০০ বছরে ওই সুবায় নতুন বসতির সুযোগ ও পরিমাণ ছিল নগণ্য।

অর্থাৎ আকবরের রাজত্বকাল থেকেই ওই সুবা ছিল জনবহুল। সুলতানি রাজত্বকালে দিল্লি-আগ্রা অঞ্চলের বসতিবিন্যাস পরিবর্তিত হয়েছিল এবং মুঘল রাজত্বে এইসব স্থানে বনজঙ্গলের কিছুমাত্র চিহ্ন ছিল না। তবে লাহোরী তাঁর রচনায় আগ্রার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলি জঙ্গলাকীর্ণ, হিংস্র পশু ও বিদ্রোহী কৃষকের আস্তানা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর বর্ণনার ওপর নির্ভর করে ড. হাবিব এই অঞ্চলগুলিকে বর্তমানকালের চম্বল বলে সিদ্ধান্ত করেছেন।

সুবা দিল্লি বোঝাতে একইসঙ্গে দোয়াব-এর ঊর্ধ্বর্তন এলাকা হরিয়ানা এবং রোহিলখণ্ডকে বলা হয়। আকবরের রাজত্বকালে এই বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রের জনবসতির যে-চিত্র আবুল ফজল দিয়েছেন তাতে এক-তৃতীয়াংশ ভাগ বৃদ্ধি ঘটে আওরঙ্গজেবের রাজত্বে। অর্থাৎ সমগ্র মুঘল রাজত্বকালে এইসব ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে কৃষির বিস্তার ঘটেছিল।

ড. হাবিবের মতে, পুরো অঞ্চলটিতে জাবত ব্যবস্থা চালু ছিল। মোরল্যান্ডের মতে বদায়ুন, বেড়েলি ও বিজনোরের মতো জেলাগুলিতে ওই সময়কালে কৃষি উৎপাদনে বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল প্রায় দ্বিগুণ। চহার গুলশন-কে উদ্ধৃত করে বলা যায় যে, সপ্তদশ শতকে এইসব এলাকায় জনবসতি যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছিল কৃষি উৎপাদনে ও তাদের বৈচিত্র্যে।

তবে এই এলাকার উত্তরাংশ যা বর্তমানকালের শাহজাহানপুর জেলা, সেটি জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। সম্ভবত আওরঙ্গজেবের রাজত্বকাল থেকেই সেই জঙ্গল কেটে বসতির বিস্তার ঘটতে থাকে। ঠিক একইভাবে জঙ্গলাকীর্ণ ছিল নৈনিতাল অঞ্চল। মোরল্যান্ড এইসব এলাকায় জনবসতি সংক্রান্ত তথ্যের অপ্রতুলতার কথা উল্লেখ করেছেন।

এক্ষেত্রে ড. হাবিব, হেনরি ইলিয়টকে উদ্ধৃত করে বলেন যে, মুসলমান প্রতিবেদকরা বর্তমান উত্তরপ্রদেশের আমরোহা, লাখনোর এবং আঁওলার উত্তরে কোনও ভূখণ্ড সম্পর্কে সঠিকভাবে অবহিত ছিলেন না। নৈনিতাল জঙ্গলাকীর্ণ হলেও দুন উপত্যকায় বসতির তথ্য আছে।

ফিরুজ তুঘলকের রাজত্বকাল থেকে দিল্লি ও বিশেষত হরিয়ানা অঞ্চলে সেচের পরিকাঠামো গড়ে উঠছিল। অবশ্য পরবর্তীকালে সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পুরো কাজে লাগানো যায়নি। তথাপি সেচখালের জল দিয়ে চাষের সুযোগ ওই অঞ্চলে ছিল। কিন্তু নতুন নতুন এলাকাকে সেচসেবিত করার কোনও প্রয়াস নেই। শাহজাহান এমনই একটি খালকে সংস্কার ও বর্ধিত করে শাহজাহানাবাদে নিয়ে আসেন।

অবশ্য তার জল কৃষি অপেক্ষা শহরের প্রয়োজনেই অধিকতরভাবে লাগানো হয়। তাই ফরাসি পর্যটক থেভানো। দিল্লিতে কৃষিখেত যথেষ্ট উর্বরা দেখলেও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তাদের অভাবের কথা লিখেছেন।

তবে পাঞ্জাবের লাহোর থেকে পশ্চিমে সিন্ধুপ্রদেশে সিন্ধু নদী কৃষির যথেষ্ট সহায়ক হিসেবে কাজ করেছিল। ঠিক এমনই এলাকা ছিল মুলতান, যা সিন্ধু উপত্যকার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আইন-ই আকবরী এবং চহার গুলশন-কে উদ্ধৃত করে ড. হাবিব দেখিয়েছেন যে, আকবরের রাজত্বকালের অনুপাতে আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে এই অঞ্চলে কৃষিখেতের বিস্তারের পরিমাণ নেহাতই নগণ্য।

অর্থাৎ মুঘল রাজত্বের শুরুর সময় থেকেই লাহোর, মুলতান এবং সিন্ধুতে জনবসতির পরিমাণ ছিল যথেষ্ট ভালো। তবে পাঞ্জাবে বারবার মোঙ্গল আক্রমণ ঘটতে থাকায় সেখানে ক্ষয়ক্ষতি নেহাত কম হয়নি।

লোদী রাজত্বকালেই (১৪৫১-১৫২৬ খ্রি.) বনজঙ্গল কেটে নতুন নতুন বসতি গড়ে ওঠে। অবশ্য মুঘলদের অধীনে পাঞ্জাবে কোনোকরম অশান্তি দেখা যায়নি। পাঞ্জাবে সমৃদ্ধির সূত্রপাত সেই সময়ে। অবশ্য শতদ্রু ও বিপাশা নদীতে বারবার বন্যার জন্য পাঞ্জাবকে কিছু মূল্য দিতে হয়েছিল। পার্শ্ববর্তী থট্টা সম্পর্কে তথ্য অপ্রতুল। মনে হয়, ওই অঞ্চলে জমি জরিপ ইত্যাদির ব্যবস্থা না থাকাই ছিল এর কারণ। তবে থট্টা, সিবিস্তান ও ভাক্করের মতো সিন্ধুর অঞ্চগুলিতে জনবসতির পরিমাণ ছিল ঘন এবং কৃষি উৎপাদনও নগণ্য নয়। অবশ্য লাহোরের মতো এখানেও বন্যার সমস্যা ছিল।

খট্টার মতোই সুবা আজমিড় সম্পর্কে তথ্যের পরিমাণ কম। তবে দীর্ঘকালযাবৎ আজমিডে গ্রামের সংখ্যায় পরিবর্তন না ঘটায় এটা অনুমান করতে অসুবিধা নেই যে, আজমিড়ে নতুন কৃষিখেত ও বসতির সুযোগ ছিল না।

গুজরাটে টোডরমলের রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা চালু হলেও আকবর পরবর্তী সময়ে তা বাতিল হয়ে যায়।

ফলত সরকারি নথি অপ্রতুল যদিও ‘মীরাট-ই-আহমদী’ গ্রন্থে কিছু জরিপ করা গ্রামের উল্লেখ আছে। কাছাকাছি তথ্য সরবাহ করে চহার গুলশন। অর্থাৎ আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে জনবসতি তথা কৃষিখেতের পরিমাণ নিয়ে বিস্তারিত বিবরণী প্রমাণ করে যে, সপ্তদশ শতকের শেষভাগ থেকে পুনরায় গুজরাটে জমি জরিপ করানোর কাজ শুরু হয়েছিল। তথাপি আইন-ই-আকবরী-তে উল্লেখিত গ্রামের পরিমাণ অনেক বেশি। এর অর্থ এমন নয় যে আকবরের রাজত্বকালে কৃষিখেতের পরিমাণ আওরঙ্গজেবের রাজত্বকাল অপেক্ষা অধিকতর ছিল।

আকবরের রাজত্বে অধিক পরিমাণ গ্রামের জমি জরিপ করে রাজস্ব ধার্য হওয়ায় এই অসঙ্গতি রয়ে গেছে। তথাপি ১৬২৯ খ্রিস্টাব্দে জেলিনসিন নামক এক ওলন্দাজ তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছেন যে, গুজরাটের মোট জমির ৯০ শতাংশ কৃষিযোগ্য। কিন্তু মোরল্যান্ড থেকে ড. হাবিব কেউ এই মন্তব্য গ্রহণ করেননি। আকবর কর্তৃক গুজরাট জয়ের পর থেকে সেখানে নতুন জমিকে কৃষিযোগ্য করার প্রয়াস চালু হলেও বহু অঞ্চল যে জঙ্গলাকীর্ণ থেকে গিয়েছিল তা শাহজাহানের রাজত্বকালে লাহোরীর রচনাতেই স্পষ্ট।

আগ্রার মতোই মালবও যথেষ্ট বসতিপূর্ণ অঞ্চল ছিল। আকবরের রাজত্বকালে সেখানে কৃষিখেতের যে পরিমাণ পাওয়া যায় আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে তা দ্বিগুণ হয়। অর্থাৎ বনজঙ্গল কেটে নতুন এলাকাকে চাষযোগ্য করার প্রক্রিয়া মালবে দীর্ঘকাল সচল ছিল। মনে রাখতে হবে যে, শাহজাহান নর্মদার দক্ষিণ তীরবর্তী মালবকে খান্দেশ সুবায় যুক্ত করে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ মালবে জমির উর্বরতা যেমন ছিল তেমনি ছিল জনবসতির চাপ। নতুবা নতুন নতুন এলাকাকে চাষযোগ্য করা সম্ভব ছিল না। মালবের উন্নত কৃষির কথা ফরাসি পর্যটক ট্যাভারনিয়েরের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি।

মালবের প্রতিবেশী খান্দেশ সম্পর্কে আবুল ফজল কোনও তথ্য সরববাহ করেননি। তবে আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে মোট গ্রামের অর্ধেকেরও কম এলাকায় জরিপ করে রাজস্ব ধার্য করা সম্ভব হয়েছিল। তবে খান্দেশ যথেষ্ট জনবহুল ছিল এবং আকবর থেকে আওরঙ্গজেব—এই দীর্ঘ সময়ে নতুন এলাকায় কৃষির বিস্তার ঘটা বিশেষ সম্ভব ছিল না। মোটামুটি এমনই চিত্র পাওয়া যাবে দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য অঞ্চলগুলিতে যেখানে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল।

ড. হাবিবের মতে, ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে পরবর্তী বছরগুলিতে নিরন্তর নতুন নতুন এলাকাকে চাষযোগ্য করার ও রাজস্ব আদায় করার প্রচেষ্টা ছিল। তবে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন রকমের চিত্র পাওয়া যায়। তাঁর মতে, সাম্রাজ্যের তিনটি অঞ্চলে বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল দ্বিগুণ। প্রথম অঞ্চলটির মধ্যে ছিল এলাহাবাদ, অযোধ্যা ও বিহার এবং সম্ভবত বাংলার কিছু অংশ, এইসব অঞ্চলে অরণ্য উৎখাত করে জমিকে কৃষিযোগ্য করা হয়েছিল।

দ্বিতীয় অঞ্চলটি ছিল বেরার যেখানে একইভাবে অরণ্য কেটে কৃষিজমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়। তৃতীয় অঞ্চলটি ছিল সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চল। সেখানে সেচখাল বৃদ্ধির ফলে কৃষির বিস্তার ঘটানো সম্ভব হয়।

কৃষি উৎপাদন

মুঘল সাম্রাজ্যের আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমিরাজস্ব। এই রাজস্ব ধার্য হত উৎপাদনকে মাপকাঠি ধরে এবং এই পদ্ধতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতে বিদ্যমান ছিল। ভূমিরাজস্ব যে কেবলমাত্র সরকারি কোষাগারকে পুষ্ট করত, তা নয়, অসংখ্য আমলা, সেনা ও অন্যান্য শ্রেণীকেও পৃষ্ট করত। অতএব কৃষি উৎপাদন বজায় রাখা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আবুল ফজল জাগীরদার-দের জাগীর বণ্টনের সময়ে যে হিসাব দিয়েছেন তাতে দেখা যায় যে, বাংলা, ওড়িশা ও বিহার ছাড়া সর্বত্র রবি ও খারিফ ফসলের মূল্য ছিল সরকারি হিসাবে ভিন্ন। অতএব রবি এবং খারিফ ফসলের আকার ও পরিমাণও ছিল সমগ্র সাম্রাজ্যে ভিন্ন। আকবর একদা সমগ্র সাম্রাজ্যকে কয়েকটি রাজস্ব বিভাগে (ক্রোড়ী) বিভক্ত করেছিলেন।

প্রতিটি বিভাগের উৎপাদনের তথ্য নিয়ে আবুল ফজল লিখেছেন যে, প্রায় প্রতিটি বিভাগেই সারা বছরে ৩৯ ধরনের উৎপাদন হত। সংখ্যাটি বহু প্রদেশে আরও অধিক ছিল। ড. ইরফান হাবিব এ প্রসঙ্গে দিল্লির উল্লেখ করেছেন। এখানে রবি মরশুমে ১৭টি এবং খারিফ মরশুমে ২৬টি ফসল উৎপন্ন হত। ১৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধুর সেহওয়ানে খারিফ মরশুমে ১৭টি, রবি মরশুমে ২২টি ফসল উৎপন্ন হত। উভয় মরশুমে উৎপন্ন ফসলের সংখ্যা ছিল ছয়টি।

বহু ক্ষেত্রেই খারিফ মরশুমে একজন কৃষক গড়ে ৪ থেকে ৬ প্রকারের ফসল বুনত বলে দাবি করা হয়। ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, ভারতের মতো উষ্ণ জলবায়ুর দেশে কৃষক যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে নানা ধরনের ফসল বোনার কৌশল যুগ যুগ ধরে প্রয়োগ করে আসছিল।

কৃষি উৎপাদনের মধ্যে প্রধান অংশটি ছিল খাদ্যশস্যের উৎপাদন। কিন্তু সমগ্র ভারতের সর্বত্র একই ধরনের ফসল উৎপাদন করা সম্ভব ছিল না। তাই উৎপাদন কেন্দ্রগুলিকে মোটা দাগে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করার ব্যবস্থা হয়েছে। ধান মোটামুটিভাবে উৎপন্ন হত বাংলা, আসাম, ওড়িশা থেকে শুরু করে করমণ্ডলের উপকূল ধরে তামিলনাড়ু পর্যন্ত, পশ্চিম উপকূলের কিয়দংশে এবং কাশ্মীর উপত্যকায়।

অযোধ্যা, এলাহাবাদ, খান্দেশ এবং বিহারে অল্পবিস্তার ধানচাষ হত এবং গুজরাটের কিছু কিছু অঞ্চলে ধানচাষে উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটানো হয়েছিল। আবুল ফজল লিখেছেন যে, সিন্ধু নদীর জল সেচের কাজে ব্যবহারের ফলে সিন্ধু ও পাঞ্জাবে যেখানে পূর্বে ধানের চাষ হত না, সেসব স্থানে তা সম্ভবপর হয়েছিল। ফরাসি পর্যটক থেভানো লাহোরে অত্যন্ত উন্নতমানের ধানের উল্লেখ করেছেন।

সাম্রাজ্যের বৃহত্তর অংশে চাষ হত গম এবং তা কালে কালে বাংলাতেও অনুপ্রবেশ করতে সমর্থ হয়েছিল। মূলত উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল থেকে শুরু করে পাঞ্জাব-হরিয়ানা, দিল্লি, বর্তমান উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মালব, গুজরাট এবং দাক্ষিণাত্যে গমের চাষ প্রচলিত ছিল। কাশ্মীর, তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটকে অবশ্য কখনো গম উৎপন্ন হত না।

গমচাষের সঙ্গে চাষ করা হত জোয়ার। জোয়ার চাষের জন্য জলের জোগান খুব বেশি জরুরি ছিল না। পাঞ্জাবের পশ্চিমাংশে, আজমিড়, গুজরাট ও খান্দেশে জোয়ারই ছিল প্রধান খারিফ ফসল। কিন্তু মালব ও সৌরাষ্ট্রে তার চাষ বেশি জনপ্রিয় ছিল না।

আবুল ফজলের দেওয়া তালিকায় ভারতের নানা স্থানে নানা জাতের ডাল উৎপাদনের তথ্য আছে। এই তালিকার সঙ্গে বর্তমানকালের ডাল উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলির কোনও পার্থক্য পাওয়া যায় না।

ডু. ইরফান হাবিবের মতে, মুঘল রাজত্বেই ভারতে প্রথম ভুট্টার চাষ শুরু হয়। সম্ভবত ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের পর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ঘুরে এই শস্যটি ভারতে প্রবেশ করেছিল। ড. হাবিবের মতে, ভারতে ভুট্টার প্রচলিত নাম হল মকাই অর্থাৎ মক্কাজাত। সেই সূত্রে একে লোহিত সাগরীয় অঞ্চলের পণ্য হিসেবে বর্ণনা করা চলে। সপ্তদশ শতকে পশ্চিম ভারত ও দাক্ষিণাত্যে ভুট্টার চাষের উল্লেখ সরকারি নথিগুলিতে পাওয়া যাচ্ছে।

মোটামুটিভাবে বলা যায় যে, সপ্তদশ শতকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যেসব ফসল উৎপন্ন হত তাদের উৎপাদনক্ষেত্র বর্তমানকালেও একই আছে। ড. শিরিন মুসভির বর্ণনায় পরিষ্কার যে, আবুল ফজল ভূমিরাজস্ব সংক্রান্ত যেসব তথ্য দিয়েছেন তা থেকে ফসলের প্রকৃতি ও উৎপাদনকাল জানা যায়। ওই তথ্যগুলির সঙ্গে আধুনিককালের কৃষিজ উৎপাদনের তালিকা তুলনা করলে দেখা যায় যে বর্তমান ভারতে চাল, গম, ভুট্টা, জোয়ার প্রভৃতির মতো প্রধান ফসলগুলি যুগ যুগ ধরে একই রকম অঞ্চলে চাষ হয়ে আসছে। এর জন্য প্রধানত জলবায়ু ও স্থানীয় মানুষের খাদ্যাভ্যাসকেই দায়ী করা চলে।

আকবরের রাজত্বকালে কিছু উচ্চমানের শস্যের উল্লেখ করেছেন আবুল ফজল। এদের বলা হত জিনস-ই-অলা, যেমন—তুলো এবং ইক্ষু। অর্থাৎ এদের অর্থকরী ফসল হিসেবে বোনা হত এবং সোজাসুজি বাজারে নিয়ে বিক্রি করা হত। তুলো প্রধানত উৎপন্ন হত খান্দেশ এবং পশ্চিম ভারতের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে, এই অঞ্চল ছাড়া উত্তর ভারত এবং বাংলাতেও তুলো চাষের উল্লেখ করেছেন ফরাসি চিকিৎসক বার্নিয়ের। তুলো চাষের ব্যয় যেমন অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি ছিল তেমনি অন্যান্য জনপ্রিয় ফসল অপেক্ষা বিঘা-পিছু উৎপাদন ছিল কম।

ইক্ষু ছিল অপর অর্থকরী ফসল। মুঘল রাজত্বে বাংলা ছিল ইক্ষু চাষের প্রধান কেন্দ্র। অবশ্য উত্তর ভারতে ইক্ষুর চাষ হত ব্যাপক এলাকা জুড়ে। তৈলবীজের মধ্যে অন্যতম ছিল তিসির চাষ। কিন্তু চাষের ক্ষেত্র যেমন অধিক ছিল না তেমনি উৎপাদনের পরিমাণও ছিল সীমিত।

অন্যান্য ফসলের মধ্যে শণের চাষও ছিল কম নয়। মুঘল রাজত্বে পাটচাষের তেমন উল্লেখ নেই। অন্য অর্থকরী ফসলের মধ্যে নীল একটা বড়ো অংশ জুড়ে ছিল। আবুল ফজল থেকে শুরু করে ট্যাভারনিয়ের পর্যন্ত প্রত্যেকেই লিখেছেন যে, আগ্রার কাছে বায়ানা ছিল নীল চাষের শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। এরপরই ছিল দোয়াব-এর স্থান।

পশ্চিম ভারতে আহমেদাবাদের কাছে সরখেজ ছিল নীলের অপর প্রধান উৎপাদনকেন্দ্র। এই অঞ্চলগুলির অতিরিক্ত বাংলা, খান্দেশ, সিন্ধু, তেলেঙ্গানা ও দাক্ষিণাত্যের ব্যাপক অংশে নীলের চাষ প্রচলিত ছিল। ড. হাবিবের দেওয়া তথ্য অনুসারে শুধুমাত্র বায়ানা দোয়াব-মেওয়াট এবং সরখেজ-সিন্ধু অঞ্চলে বার্ষিক গড় উৎপাদন ছিল ৮১৬.৪ টনের মতো। এই হিসাবে ভারতের মোট উৎপাদন কী পরিমাণে ছিল তা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না।

বার্নিয়ের পূর্ব ভারতে বিশেষত বাংলায় সিদ্ধির চাষ উল্লেখ করেছেন। তবে সপ্তদশ শতকের ভারতে কৃষিতে অন্যতম সংযোজন হয়েছিল তামাকের। আবুল ফজলের রচনায় তামাকের কোনও উল্লেখ না থাকায় সিদ্ধান্ত করা হয় যে, ষোড়শ শতকে উত্তর ভারতে তামাকের কথা কেউ জানত না। তবে আসাদ বেগকে উদ্ধৃত করে ড. হাবিব লিখেছেন যে, ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে আকবরকে বিজাপুর থেকে তামাক সমেত ‘ছিলিম’ সেবনের জন্য পাঠানো হয়েছিল।

যদিও জাহাঙ্গীর ধূমপান সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন তথাপি অতি দ্রুত তা জনপ্রিয়তা অর্জন করে। গুজরাটে প্রথম তামাক চাষের উল্লেখ পাওয়া যায় এবং জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালেই। অতি দ্রুত তামাক চাষ সিন্ধু থেকে শুরু করে পূর্ব ভারতের বিহার পর্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল।

মশলার মধ্যে বাংলার পিপুলের চাষ জনপ্রিয় ছিল। তবে গোলমরিচ যা ওলন্দাজদের বাণিজ্যে প্রধান পণ্য ছিল, সেটি জন্মাত প্রধানত মালাবার অঞ্চলে। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে লঙ্কার চাষ শুরু হয়। অন্যতম প্রধান একটি মশলা হিসেবে জাফরানের উল্লেখ আছে। কিন্তু কাশ্মীরে এর সীমিত চাষ হত এবং এ কারণে তা সাধারণের ব্যবহার্য হতে পারেনি। ধনী ব্যক্তিদের রন্ধনশালায় ও রপ্তানি বাণিজ্যের পণ্য হিসেবে তা ব্যবহৃত হত।

সরাসরি কৃষি উৎপাদন না হলেও রেশম কৃষিজ পণ্য হিসেবেই পরিগণিত। সুলতানি রাজত্বকালে বাংলায় রেশমকীট পালন জনপ্রিয় হয় এবং চীন থেকে অসম হয়ে তা বাংলায় প্রবেশ করে। উত্তর ভারতে রেশম চাষের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। তবে কাশ্মীরের কিয়দংশে তা সফল। কিন্তু সেখানে রেশমকীট পালনের কৌশল তিব্বত থেকে আমদানিকৃত।

অনেকের মতে, প্রতিবছর অন্তত ছয়বার রেশমকীট থেকে রেশমগুটি উদ্ধার করা সম্ভব। বিদেশি পর্যটকরা বাংলার রেশমের যথেষ্ট প্রশংসা করেছেন। কাশিমবাজারের রেশমের উন্নতমানের জন্যই আর্মানি থেকে শুরু করে ওলন্দাজ, ইংরেজ ও ফরাসি বণিকরা সেখানে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেছিল। অষ্টাদশ শতকের শুরুতে এখান থেকে প্রতি বছর গড়ে ১২ থেকে ১৫ হাজার মন রেশম রপ্তানি হত।

রেশমের অতিরিক্ত তসর ছিল অপর একটি কৃষিজ উৎপাদন। পূর্ব ভারতে বাংলা, ওড়িশা ছাড়া দাক্ষিণাত্যের কোনও কোনও অংশে তসর উৎপন্ন হত। অসমে এই জাতীয় পণ্যেরই রকমফের ছিল, যা মুগা নামে অধিক পরিচিত।

কৃষক ও জমির অনুপাত হিসাব করলে মুঘল ভারতে কৃষক ছিল মহার্ঘ। এর ফলে যথেচ্ছ চাষ করা সম্ভব ছিল এবং কৃষিপণ্যের মধ্যে বৈচিত্র্য আনার স্বাধীনতাও ছিল। আবুল ফজল লিখেছেন যে, একজন কৃষক সর্বোচ্চ সংখ্যায় ৪টি বলদ, ১টি মহিষ এবং ২টি গরুর জন্য কোনওরকম কর দিত না। সপ্তদশ শতকের নানা তথ্য থেকে এটা প্রমাণ করা যায় যে, গবাদি পশুর সংখ্যা মুঘল ভারতে যথেষ্ট রকমের ভালো ছিল। কিন্তু ওই গবাদি পশুকে হাল টানার জন্য কতটা নিয়োগ করা হত সে বিষয়ে বিতর্ক আছে।

কৃষিভিত্তিক শিল্প

দীর্ঘকালযাবৎ ভারতে কৃষক পরিবারগুলি কৃষিপণ্যভিত্তিক নানা জাতের কারিগরী উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সে সবই ছিল কুটিরশিল্প এবং সাধারণভাবে আঞ্চলিক স্তরে তাদের বিপণন হত। কারিগরী উৎপাদনের মধ্যে প্রথমেই যেগুলির কথা উল্লেখ করতে হয় তাদের মধ্যে আছে ধান ভানাই করে চাল ও গম পেষাই করে আটা উৎপাদন করা। এগুলির জন্য ঢেঁকি, চাকি ইত্যাদির মতো সহায়কের প্রয়োজন থাকলে তাদের কৃষিজ শিল্প হিসেবে কোনও সময়ে চিহ্নিত করা হয়নি।

কৃষিজ শিল্প বলতে ভারতে সর্বাগ্রে যেটির উল্লেখ করতে হয় তা হল ইক্ষু পেষাই করে রস নির্গত করা ও তাকে জ্বাল দিয়ে গুড় ও আরও প্রকৃষ্ট প্রথায় চিনি উৎপাদন করা। কাঠের জাঁতার মতো যন্ত্রের সাহায্যে বলদের মাধ্যমে ও হাত ঘুরিয়ে আখ পিষে রস বের করার কাজ দীর্ঘকালযাবৎ ভারতের মানুষ করত।

ড. ইরফান হাবিবের মতে, গাঙ্গেয় সমভূমিতে পাথরের বা লোহার চাকা লাগিয়ে ওই পদ্ধতিকে আরও উন্নত করা হয়। আগুনের ওপর লোহার কড়া বসিয়ে কী পদ্ধতিতে সেই রস জ্বাল দেওয়া হত তা এক অদ্ভূত কারিগরী। ফরাসি পর্যটক কারেরীর বিবরণীতে গুড় জ্বাল দেওয়ার নানা পর্যায়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

ইক্ষুর রস থেকে গুড় বা শুদ্ধ প্রক্রিয়ায় লাল চিনি (যাকে খান্দসেরী বলা হত) প্রস্তুত ছাড়াও মদ তৈরির প্রক্রিয়া ভারতে প্রচলিত ছিল। গ্রামের কৃষকদের কাছে মদ প্রস্তুত এক অতিরিক্ত জীবিকার সন্ধান দেয়। ইক্ষু ছাড়া তালের রস থেকেও বাংলা, ওড়িশা প্রভৃতি অঞ্চলে মদ প্রস্তুত হত।

ইক্ষু পেষার মতোই সরিষা, তিল, তিসি প্রভৃতি তৈলবীজকে পেষাই করে ভোজ্য তেল ও জ্বালানি তেল তৈরির পদ্ধতি ভারতে অজানা ছিল না। মোটামুটি একই পদ্ধতি অনুসরণ করে তৈলবীজ পেয়া হত এবং সে কাজে বলদের সাহায্য নেওয়া হত। ভারতীয় বর্ণগুলির মধ্যে কলুর এক বিশেষ স্থান থাকায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, প্রাচীনকাল থেকে এরা তেল পেষার পেশায় নিযুক্ত ছিল। মুঘল রাজত্বে গাঙ্গেয় সমভূমিতে তৈলবীজের চাষ যেমন ব্যাপকভাবে হত তেমনি তেল উৎপাদনও হত।

ভূমিরাজস্বই ছিল সাম্রাজ্যের আয়ের প্রধান উৎস। কিন্তু কৃষির প্রতি কোনও সম্রাটই যত্নবান ছিলেন না। মুহম্মদ বিন তুঘলক একটি সরকারি কৃষিবিভাগ খুলে কৃষির উন্নতিতে নজর দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে পরবর্তীকালে কেউ অনুসরণ করেননি যদিও ফিরোজ তুঘলক কিয়দংশে সরকারি দায় বহনের নজির রেখে গেছেন।

মুঘল রাজত্বেও কৃষির উন্নতি এবং সেই সঙ্গে কৃষকের উন্নতির জন্য সরকারি চিন্তাভাবনার তথ্য বিশেষ নেই। অবশ্য আকবর প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের নিজ নিজ সুবা-য় কূপ খনন, জলাশয় নির্মাণ এবং উদ্যান পালনের জন্য বিশেষভাবে যত্নবান হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর নির্দেশ কতখানি অনুসৃত হয়েছিল বা ফল কীরূপ হয়েছিল এ বিষয়ে আমরা কিছু জানি না।

জলসেচ

মুঘল সাম্রাজ্যের প্রধান কৃষি অঞ্চল হিসেবে দোয়াব-এর স্থান ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বলাই বাহুল্য যে, গঙ্গা-যমুনা বিধৌত ক্ষেত্রে জলসেচের সুযোগ ও প্রয়োগ ছিল অন্যান্য অঞ্চল অপেক্ষা অধিকতর। গঙ্গা-পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি সম্পর্কে তথ্যের কোনও অভাব না থাকায় প্রমাণ হয় যে, এই অঞ্চল কতখানি জনবহুল ছিল এবং কী পরিমাণে রাজস্ব সেখান থেকে আদায় করা হত। সিদ্ধান্ত করতে অসুবিধা হয় না যে, জলের প্রাচুর্যই কৃষি উৎপাদনে বৃদ্ধির সহায়ক হয় ও সেই সূত্রেই রাজস্ব আদায় ছিল নিয়মিত।

এলাহাবাদ ও অযোধ্যা প্রদেশদুটিকে সম্পন্ন বলার যথেষ্ট কারণ আছে। এ দুটি গঙ্গা-যমুনা দোয়ার এর একাংশ ও গঙ্গা-ঘর্ঘরা দোয়াব-এর কেন্দ্রে অবস্থিত। এই অঞ্চলে বনজঙ্গলের উল্লেখ বিশেষ না থাকায় ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, কৃষির বিস্তার ও জনাধিকাই ছিল তার মূল কারণ।

মোটামুটিভাবে বলা চলে যে, হরিয়ানা থেকে শুরু করে দোয়াব পর্যন্ত ভূখণ্ডে সেচখালের গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। সুলতান ফিরোজ তুঘলক (১৩৫১-৮৮খ্রি.) হরিয়ানার সঙ্গে যমুনা নদীকে একাধিক খালের সাহায্যে যুক্ত করেন এবং তার ফলে ওই অঞ্চলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ফিরোজ তুঘলকের সেচখালগুলি এতই বিচক্ষণতার সঙ্গে খনন করা হয়েছিল যে, ইংরেজরা পাঞ্জাব দখলের পরে ঊনবিংশ শতকে তাদের নতুন করে সংস্কার করায়। এদের পশ্চিম যমুনা খাল হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

মুঘল রাজত্বের রাজস্ব সংক্রান্ত নথিগুলিতে অধিকাংশ কৃষিজমিকে ইয়াক-ফসল (এক ফসল) হিসেবে উল্লেখ করা হলেও দো-ফসল খেতের উল্লেখও পাওয়া যায়। বাংলায় প্রতিবছর তিনটি ফসল উৎপাদনের তথ্য আছে। স্বাভাবিকভাবেই যে যে জমিতে জলের সরবরাহ উন্নত ছিল সেসব জমিতেই অধিক সংখ্যায় ও অধিক পরিমাণে শস্য উৎপাদন করা যেত।

দীর্ঘকালযাবৎ ভারতে কৃষিকাজে নদী ও বৃষ্টির জল ছাড়া অন্যান্য প্রক্রিয়ায় যেমন— কূপ, পুকুর ও খাল খননের মাধ্যমে সেচের কাজ চলত। গাঙ্গেয় সমভূমি ও দাক্ষিণাত্যে কূপই ছিল সেচের প্রধান উৎস।

বাবরনামা-য় লাহোর, দীপালপুর ও সিরিহিন্দে যে-সেচব্যবস্থা চালু ছিল তার উল্লেখ আছে। প্রধানত কাঠের তৈরি অরঘট্ট (যাকে পারসিক জলচাকা বলা হত) লোহার শিকলে বেঁধে একটি চাকার সাহায্যে জল তুলে জমিতে ফেলার পদ্ধতি ছিল।

ড. হাবিব মন্তব্য করেছেন যে, শুধুমাত্র পাঞ্জাবেই নয়, সিন্ধু ও মাড়ওয়ার প্রভৃতি অঞ্চলে এই জাতীয় পারসিক জলচাকার ব্যবহার ছিল। কিন্তু আগ্রা এবং পূর্বদিকে চামড়ার ভিত্তি (চরস) একটি কপিকলে ঝুলিয়ে বলদের সাহায্যে জল তোলার কাজে ব্যবহৃত হত। তবে জমির সমান্তরাল জলপ্রবাহ বা উৎস থাকলে ঢেঁকলি নামক একই ধরনের জলের পাত্র ব্যবহার করা হত।

মোরল্যান্ডের ভাষায়, আকবরের রাজত্বকাল থেকে কৃষিব্যবস্থায় কিছুটা উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। নতুন ফসলের চাষ, নতুন এলাকাকে কৃষিজমিতে রূপান্তরিত করা ইত্যাদি ছিল প্রধান। এর মধ্যে জলসেচ ব্যবস্থাকেও যুক্ত করা চলে।

জমিতে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় জলের বৃহৎ অংশটি পাওয়া যেত বৃষ্টি থেকে। বৃষ্টির জলেই অযোধ্যার মতো উর্বরা ক্ষেত্রে জমি চাষ হত। ডব্লু. এইচ. মোরল্যান্ড সেচব্যবস্থার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ওই অঞ্চলে কুপ খননের কোনও উল্লেখ করেননি। অর্থাৎ বৃষ্টির জলই ছিল কৃষির প্রয়োজনীয় জল। আবুল ফজল ও সুজন রাইয়ের মতো সমকালীন প্রতিবেদকদের রচনাতেও মানুষের কাটা কূপের কোনও উল্লেখ অযোধ্যা অঞ্চলে নেই।

স্টিল ও ক্রোথারের মতো পর্যটক যাঁরা ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতে এসেছিলেন বা একই সময়ে আগত অপর পর্যটক ফিঞ্চ, কেউ উত্তর ভারতে রবি চাষের সময়ে সেচের উল্লেখ করেননি। সম্ভবত কৃত্রিম উপায়ে খেতে জল সরবরাহ নিয়ে বিশেষ ভাবনা ছিল না। অধিকাংশ খেতই বৃষ্টির দ্বারা সেবিত হত। এর জন্য একটি প্রধান কারণ হল অপর্যাপ্ত জমির উপস্থিতি।

অযোধ্যার উর্বর কৃষিক্ষেত্রের জন্য নিকটবর্তী নদীগুলির কথা আবুল ফজল উল্লেখ করেছেন। সরয়ূ এবং ঘর্ঘরা নদী বর্ষাকালে দুকুল ছাপিয়ে বন্যার জলে মাইলের পর মাইল জমিকে ভাসিয়ে দিত। এটা ছিল এক বাৎসরিক ঘটনা। বন্যার জল নেমে যাওয়ার পর জমি পলিতে পূর্ণ হত এবং সেই জমি ছিল চাষের কাজে বিশেষ উপকারী। ঠিক এমনই চিত্র ছিল সম্ভলে।

পাঞ্জাবে শতদ্রু এবং বিপাশা নদীর মিশ্রণের ফলে জল বহনের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। পুনরায় তারা ফিরোজপুরের কাছে এসে একে অন্যের থেকে পৃথক হয়ে যায়।” কিন্তু দুই ধারায় প্রবাহিত দুটি নদীর জলস্রোতে ভাঁটা পড়েনি। এরই ফলে পাঞ্জাবের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চাষের কাজে নিয়মিত জলের জোগান বজায় ছিল। কিন্তু আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে বিপাশা তার পূর্বতন গতিপথ বদল করলে একদা সুজলা-সুফলা ক্ষেত্র হঠাৎ জলশূন্য হয়ে যায় ও তারই ফলে কৃষিকাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়।

নদীর গতিপথ পরিবর্তনে চাষের পাশাপাশি জনবসতিতেও পরিবর্তন ঘটতে দেখা গেছে। এ প্রসঙ্গে সব থেকে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল সিন্ধু। বারবার তার গতি পরিবর্তিত হওয়ায় সিন্ধু উপত্যকায় কৃষিক্ষেত্রের মানচিত্র ছিল সদা পরিবর্তনশীল। তবে নিরন্তর নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে যেমন বড়ো বড়ো হ্রদের সৃষ্টি হত তেমনি কৃষিক্ষেত্রের আয়তনে পরিবর্তন আসত। নতুন এলাকা স্বাভাবিক নিয়মে সেচসেবিত হত এবং পূর্বতন এলাকা থেকে চাষ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হত। কিছু ক্ষেত্রে মানুষ খাল খনন করে নদীর সঙ্গে যুক্ত করে চাষের ব্যবস্থা করত।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল দাক্ষিণাত্যের বগলানা, যেখানে প্রায় প্রতিটি গ্রামেই সেচখালের উপস্থিতি দেখা গেছে। গ্রামের মানুষ সমবায়ের (ফাদ) মাধ্যমে ওই খালগুলির সংস্কার করত। উত্তর ভারতে ফিরোজ শাহ তুঘলক চতুর্দশ শতকের শেষপর্বে সেচখাল খননের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন।

ফিরোজ শাহর রাজত্বকালে যমুনা নদী থেকে একটি এবং শতদ্রু থেকে অপর একটি খাল হরিয়ানার হিসার ফিরোজা পর্যন্ত কাটা হয়েছিল। এছাড়াও যমুনা নদী থেকে রজওয়া এবং উলুঘখানী নামে অপর দুটি খাল কেটে হিসার পর্যন্ত প্রসারিত করা হয়।

ফিরোজ শাহর রাজত্বকালেই হান্সি পর্যন্ত প্রসারিত যমুনা নদী থেকে কাটা সেচখাল প্রভূত পরিমাণে জল ‘বহন করত। কিন্তু ষোড়শ শতকে ফিরোজ শাহর সময়ের খালগুলি সম্ভবত বুজে গিয়েছিল। আকবরের প্রদত্ত (১৫৭০-৭১ খ্রি.) একটি সনদকে উল্লেখ করে ড. আভা সিংহ লিখেছেন যে, বছরে ৪-৫ মাস ওই খালগুলিতে জল থাকত।

অতএব তাদের সংস্কার ছিল জরুরি এবং আকবরের রাজত্বে ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে তাদের সংস্কারের কাজ শুরু হয়। সংস্কৃত খালের নতুন নাম হল শিহাবনহর। সম্ভবত ওই খালের সংস্কার ও প্রসার ঘটাতেই ১৫৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দে আকবর একটি সনদ প্রদান করেন। আবুল ফজলের বর্ণনা অনুসারে নতুন সংস্কৃত খাল কারনালের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ছিল।

এর ফলে হাসি ও হিসার পর্যন্ত বহমান খালে সারা বছরই জল পাওয়া সম্ভব হয়। বদায়ুনী লিখেছেন যে, মীর-ই-অব (সেচ বিভাগের অধিকর্তা) নুরুদ্দীন মুহম্মদ তরখানের তত্ত্বাবধানে ওই খালের রক্ষণাবেক্ষণ হত। আকবর নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, খাল যেসব পরগনার ওপর দিয়ে প্রবাহিত তাদের প্রতিটিতে বসবাসকারী কৃষকরা যেন উপকৃত হয়।

যুবরাজ সেলিমের নামাঙ্কিত শেখু নি (কারণ আকবর সেলিমকে শেখু বাবা বলে সম্বোধন করতেন) ১২৫ মাইল দূরবর্তী স্থান পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। আকবর সেইসব খালের সংস্কার করিয়ে দেন। হাদি ও ভদ্রা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সেই খাল। পরবর্তীকালে শাহজাহান নতুন উদ্যমে এর সংস্কার ঘটিয়ে রাজধানী শাহজাহানাবাদ পর্যন্ত তাকে প্রসারিত করেন।

যমুনা এবং শতদ্রু নদীর মধ্যভাগে অবস্থিত বর্তমান হরিয়ানার মাটি ছিল উর্বরা। এই অঞ্চলে বর্ষাকালে ছোটো-বড়ো ঝরণা ও নদীতে জল ভরে যেত এবং সেগুলি মরু অঞ্চলে একাধিক নদীখাতকে পূর্ণ করতে সাহায্য করত। ড. হাবিব লিখেছেন যে, এই অঞ্চলে কৃষকরা বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ রুদ্ধ করে রাখত। জলে পূর্ণ নদী তখন তার দুই কূল ছাপিয়ে পার্শ্ববর্তী জমিকে প্লাবিত করত এবং সেসব অঞ্চল উর্বর হয়ে উঠত।

পাঞ্জাবে মূলত উচ্চ বরি দোয়াব অঞ্চলে সেচখালগুলি চাষের জল জোগাত। শাহজাহানের রাজত্বকালে ইরাবতী নদী থেকে শাহনহর খাল খনন করিয়ে ৮৪ মাইল দূরে লাহোর শহর পর্যন্ত তা বিস্তৃত করা হয়েছিল। শাহজাহানের রাজত্বকালের শুরুতে এটি খিজিরাবাদ থেকে ৭৫ মাইল দূরবর্তী হরিয়ানার সফেদন পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। নদী বা খাল থেকে জল উত্তোলনের জন্য জলচাকার ব্যবহার জনপ্রিয় ছিল না।

যেসব কৃপ থেকে জল উত্তোলিত হত সেগুলির প্রায় সবই ছিল কাঁচা। এই জন্য ড. ইরফান হাবিব সিদ্ধান্ত করেছেন যে, প্রতিবছরই এইসব কূপ খনন করতে হত। ১৬২৬ খ্রিস্টাব্দে পেলসার্ট যে-বিবরণী লিখেছেন তাতেই দেখা যায় যে, প্রতিবছরই রবি ফসল চাষের পূর্বে আগ্রা অঞ্চলে নতুন কূপ খনন করা হচ্ছে। এমনই জাতের কূপ ছিল আজমিড় সুবা-তে। সম্ভবত সে যুগে ভূগর্ভস্থ জলস্তর ছিল যথেষ্ট ও খনন করে জল, উত্তোলন করার সমস্যা বিশেষ ছিল না।

এই জাতীয় কূপ খনন করার জন্য বিশেষ একশ্রেণীর ভবঘুরে শ্রমিক পাওয়া যেত, যাদের উল্লেখ বদায়ুনীর রচনাতে পাওয়া যায়। আবুল ফজলও পাঞ্জাবে কূপের জালে অধিকাংশ কৃষিকাজের উল্লেখ করায় এটা সিদ্ধান্ত করা চলে যে, উত্তর ভারতে কূপের জলের সেচ ছিল অতি সাধারণ ঘটনা। দোয়াব অঞ্চলেও এর কিছু উল্লেখ ছিল, যদিও ঊনবিংশ শতকে একাধিক সেচখাল কাটার জন্য কূপের গুরুত্ব সেখানে হ্রাস পায়।

কূপগুলির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল গ্রামীণ সমাজের। কিছু অঞ্চলে আবার সরকারি আধিকারিকরা নিযুক্ত ছিল। নিগারনামা-ই-মুনশি থেকে জানা যায় যে, মুলতান সুবায় সেচ বিভাগের জন্য পৃথক আধিকারিক নিয়োগ করা হত যার কাজ ছিল সেচখাল খনন করা এবং বাঁধগুলির পরিচর্যা করা। উত্তর ভারত জুড়ে কৃষকদের সাহায্যে এই ধরনের সরকারি কর্মচারীরা সেচের উৎসগুলির (জুই-আব) নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করত।

১৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে শাহজাহান যমুনা নদী নিঃসৃত খালকে হরিয়ানায় চিতাঙ্গ পর্যন্ত প্রসারিত করার ব্যবস্থা করেছিলেন। ওই বছরই হিসার চাকলা-র কৃষকরা জলের অভাব নিয়ে সম্রাটের কাছে দাবিপত্র প্রেরণ করে। হিমালয় থেকে ২০০ মাইল (মুঘল নথির ভাষায় ৮০ কুরোহ) দূরে পার্বত্য নদীর সঙ্গে যুক্ত করা হল সেই খালকে।

বর্তমান পাঞ্জাবের সিরহিন্দ জেলা জুড়ে সেচের কাজের জন্য নতুন খাল প্রসারিত হয়। লাহোর পর্যন্ত অন্য একটি খালকে প্রসারিত করা হয়েছিল। খাল কাটার ব্যয়বাবদ রাজকোষ থেকে অর্থ বরাদ্দ করা হয় এবং সম্ভবত পরবর্তীকালে সেচসেবিত এলাকার কৃষকরা জলকর দিয়ে ব্যয় পুরণ করে দেয়।

শাহজাহান তাঁর রাজধানী শাহজাহানাবাদে (দিল্লি) জলসরবরাহের জন্য ফিরোজ শাহের রাজত্বে খনন করা একটি সেচখালকে শাহজাহানাবাদ পর্যন্ত প্রসারিত করেছিলেন। এর নাম করা হয় নাহর-ই-বিহিস্ত। যমুনার দক্ষিণ তীর থেকে জল বহন করে দাদপুরের কাছে ফতেগড়ে সেই জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। সারা বছর একই মাত্রায় জলপ্রবাহ বজায় রাখার জন্যই এটা করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে রাজা জয় সিংহ এর সংস্কার করে নামকরণ করেন জয়সমুন্দ।

এমনিভাবে সেচখাল খননের মাধ্যমে সিন্ধুতে কৃষির উন্নতি ঘটানো হয়। বার্নিয়ের সিন্ধুতে ছোটো ছোটো খালের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। এদের বলা হত কারীজ, যেগুলির সঙ্গে অধিকাংশ স্থলে কোনও নদীর যোগ ছিল।

বার্নিয়ের কাশ্মীরে পাহাড়ের কোলে মাটির বাঁধ দিয়ে জল ধরে রাখার কথাও উল্লেখ করেছেন। কাশ্মীরে জাহাঙ্গীরের রাজত্বে যেসব মনোরম উদ্যান গড়ে তোলা হয়েছিল সেগুলিতেও এই প্রক্রিয়ায় জল সরবরাহ করা হত।

দক্ষিণে কৃষির কাজে জলসেচের সুবন্দোবস্ত ছিল। মনে রাখতে হবে যে, উত্তর ভারতের জল দক্ষিণে সর্বত্র সুলভ নয়। ষোড়শ শতকের শুরুতে বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব রায় স্বয়ং সেচব্যবস্থা নিয়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন এবং পাথুরে উপত্যকায় চাষের জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করেছিলেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দক্ষিণে জল ধরে রাখার জন্য বাঁধ জনপ্রিয় ছিল। এই বাঁধ-গুলিতে যে-পদ্ধতিতে বর্ষার জল সঞ্চিত রাখার ব্যবস্থা ছিল বর্তমান শতাব্দীতেও তা চালু আছে।

আদার-ই-আলমগিরি-কে উদ্ধৃত করে ড. হাবিব লিখেছেন, যে, শাহজাহান ৪০-৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করেছিলেন খান্দেশ ও বেরারের পাইনঘাট অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণের জন্য। এই জাতীয় জলক্ষেত্র পার্শ্ববর্তী রাজ্য গোলকুণ্ডাতেও দেখা যায়। ট্যাভারনিয়ের গোলকুণ্ডা রাজ্যের বিবরণী দেওয়ার সময়ে সেখানে অগণিত কূপের অস্তিত্ব বিস্মৃত হননি।

এমন পাকা বাঁধের কথাও তিনি লিখেছেন যাদের বিস্তৃতি কম করে দেড় মাইলের মতো। এগুলি পাথরের বাঁধানো এবং বৃষ্টির জল দীর্ঘকাল ধরে রাখার পক্ষে উপযুক্ত। মাসির-ই-আলমগিরি থেকে জানা যায় যে, বিদরের বিখ্যাত কামথানা হ্রদ থেকে দূর-দূরান্তে বিস্তৃত কৃষিখেতে জলসেচ করা হত।

Leave a Reply