কলের কলকাতা : সুভাষ মুখোপাধ্যায়,”আমার বাংলা”- bnginfo.com
কলের কলকাতা : সুভাষ মুখোপাধ্যায়,”আমার বাংলা”- bnginfo.com

কলের কলকাতা : সুভাষ মুখোপাধ্যায়,”আমার বাংলা”- bnginfo.com

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের “আমার বাংলা” গ্রন্থের উল্লেখিত ‘কলের কলকাতা’ এই প্রবন্ধের সূচনায় লেখক তার গ্রামের কিশোর মোনা ঠাকুরের জবানীতে ‘আজব শহর কলকাতা’র রূপটিকে ব্যক্ত করেছেন। রচনার লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায় এগারো বছর বয়সে কলকাতায় আসেন। প্রবন্ধে তিনি দম দেওয়া কলের পুতুলের মতো মানুষগুলোর দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামের ছবি যেমন এঁকেছেন, তেমনই রূপ দিয়েছেন শহরাঞ্চলের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা গুলি উল্লেখ করেছেন।

দ্বাদশ শ্রেণি: কলের কলকাতা – বিশ্লেষণধর্মী, বর্ণনাধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলী [প্রতিটি প্রশ্নের মান ৫]

“হঠাৎ একদিন খেপে উঠল কলের কলকাতা।” ‘কলকাতার খেপে ওঠা’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে ? কলকাতার ‘খেপে ওঠা’-র ফল কী হয়েছিল ?

সুভাষ মখোপাধ্যায়ের আমার বাংলা গ্রন্থের অন্তর্গত ‘কলের কলকাতা’ রচনা থেকে উদ্ধৃতিটি সংকলিত হয়েছে! কলকাতার ‘ক্ষেপে ওঠা’ বলতে লেখক ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে কলকাতাবাসীর ‘যুদ্ধংদেহী’ অংশগ্রহণকেই বুঝিয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর দই এবং তিনের দশকে অসহযোহ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, বিলিতি দ্রব্য বর্জন আন্দোলন ইত্যাদি নানা স্বদেশি আন্দোলনে সমগ্র দেশ উত্তাল হয়েছিল। একেই লেখক ‘ক্ষেপে ওঠা’ বলেছেন।

স্বাধীনতা আন্দোলনে শুধু কলকাতার রাজপথগুলিই নয়, শান্ত গলিগুলিও অশান্ত হয়ে ওঠে। কলকাতার সর্বত্র রাস্তার মোড়ে মিটিং চলতে থাকে। স্কুলকলেজ শুরু হয়ে পিকেটিং। ঘরে বসে না থেকে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। এরপর সারা শহরে আগুন জ্বলতে থাকে, আর সে আগুনে বিলিতি কাপড় পোড়ানো হতে থাকে। দলে দলে মানুষ পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বিলিতি কাপড় পোড়ানোর আহ্বান জানাতে থাকে।

দু-পাশের বাড়ি থেকে তাদের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দেওয়া হতে থাকে বিলিতি কাপড়। রোয়াকে বসে থাকা বৃদ্ধের দল তকলি ঘুরিয়ে সতো কেটে চলেন। খদ্দরের টুপি পরার হিড়িক লেগে যায়। যেখানে-সেখানে ধ্বনিত হতে থাকে ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনি। লাল-পাগড়িপরা ইংরেজ সরকারের পুলিশের সঙ্গে জনসাধারণের সংঘর্ষ বেধে যায়। কোথাও কোথাও চলে পুলিশের লাঠিচার্জও। এসবই ছিল কলকাতার ‘ক্ষেপ ওঠার ফলশ্রুতি।

কলকাতাবাসী লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা থেকে কীভাবে বক্সা পৌঁছে ছিলেন, তার বর্ণনা করো। অথবা, মেঘের গায়ে জেলখানা দেখার যাত্রী লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায় যাত্রাপথে বর্ণনা দাও।

‘মেঘের গায়ে জেলখানা’ রচনার লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায় বিশ শতকের পাঁচের দশকের কোনো একদিন বাড়ি থেকে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে সাহেবগঞ্জগামী প্যাসেঞ্জার ট্রেনে ওঠেন। সেই ট্রেন ঢিমে তালে বাংলার সীমান্ত পেরিয়ে পরদিন অবিভক্ত বিহারের সাহেবগঞ্জ স্টেশনে পৌঁছোয়। সেখান থেকে গঙ্গানদীর সকরিগলি ঘাটে পৌঁছোন লেখক। তারপর রাতের বেলাতেই খেয়াপারাপারকারী স্টিমারে নদী পার হয়ে পৌঁছোন মণিহারি ঘাটে।

গঙ্গার ঘাট থেকে নেমে নিয়ে লেখক পৌঁছোন স্টেশনে। মিটারগেজ লাইনের সেই ট্রেন যাত্রা শুরু করে কাটিহার, পূর্ণিয়া, কিষাণগঞ্জ অতিক্রম করে একসময় বাংলাদেশের প্রবেশ করে। ট্রেন এরপর হিমালয়ের কাছাকাছি পৌঁছোয়।

নকসালবাড়ি, হাতিঘিষা, বাঘডোগরা প্রভৃতি স্টোশন পার হয়ে ট্রেন শিলিগুড়ি পৌঁছোয়। শিলিগুড়ি জংশন পার হয়ে ট্রেনটি ডানদিকে বাঁক নিয়ে কিছুটা এগিয়ে তিস্তা রেল সেতু অতিক্রম করে। লেখক তখন নীচ দিয়ে প্রবাহিত খরস্রোত তিস্তাকে দেখতে পান।

এক ছোট্ট স্টেশনে ট্রেন থামলে লেখক কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গ দেখতে পান। এরপর একসময় রাজাভাত খাওয়া স্টেশন এলে সেখানে নেমে পড়েন তিনি। সেখান থেকে ট্রাকে সওয়ারি হয়ে দীর্ঘ চা-বাগান এলাকা অতিক্রম করে পাহাড়ি চড়াই পথে একসময় পৌঁছোন ‘সান্তালবাড়ি’। সেখান থেকে দু-মাইল চড়াই পথ পায়ে হেঁটে লেখক পৌঁছোন বক্সায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন কলকাতায় যেসব ঘটনা ঘটেছিল, ‘কলের কলকাতা’ রচনা অবলম্বন করে তার বর্ণনা দাও।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কলের কলকাতা’ রচনায় আমরা দেখি যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) শুরু হলে কলকাতাতে এসে পৌঁছোয় তার হুংকার। অন্ধকারে কলকাতার দেয়ালে দেয়ালে কারা সেঁটে দিয়ে যায় গোটা গোটা হরফের নিষিদ্ধ ইস্তেহার। কলকাতার রাস্তা ফেটে পড়ে অন্ধ রাগে। বিয়াল্লিশ-এর আগস্টে ট্রাম পোড়ানো হয় কলকাতায়। ফলে লাঠি নয়, রাস্তায় গুলি চলে। কিন্তু কলকাতার নবীন যুবকরা অকুতোভয় । বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদেরও মনে কোনো ভয়ডর নেই। ইট হাতে নিয়ে তাঁরা দাঁড়ায় বন্দুকের সামনে। বলে চলে, “ইংরেজ, ভারত ছাড়ো।”

এই আগুন একদিন নিভল। কিন্তু এরপর শুরু হল পঞ্চাশের (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের) মন্বন্তর। কলকাতার ফুটপাথ ভরে গেল মরা মানুষের ভিড়ে। গ্রামগুলো পেটের জ্বালায় উঠে এল শহরে। সেইসময় মড়া ডিঙিয়ে পথচারীকে রাস্তা চলাচল করতে হচ্ছিল। বাতাসে এমন দুর্গন্ধ হল যে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল। কলকাতার শরীরে এইভাবে শুরু হল পচন।

তারপর একদিন গ্রামবাংলার বীজ বোনা মাঠে ধানের শিষ যখন পেকে উঠল, তখন শহরে আসা শোক-তাপ-জর্জর গ্রামবাসীরা ফিরে গেল তাদের জন্মস্থানে। তবে, অনেক মা কোল খালি করে গেল, অনেক বউ গেল হাতের শাঁখা-পলা ঘুচিয়ে।

কলের কলকাতা তখন অনেকটাই স্বাভাবিক হল। তবে, বোমা পড়ার ভয়ে ‘ব্ল্যাক নাইট’ অর্থাৎ ‘আলো-নেভানো রাত’ কাটাতে লাগল কলকাতাবাসী। একদিন দিনের বেলা ডালহৌসি ও খিদিরপুরে জাপানিরা বোমা ফেলে গেল। বন্দরের শ্রমিকরা মাছির মতো মরল এরপর একদিন বিশ্বযুদ্ধ থেমে গেলে আলোর ঠুলিগুলো খুলে নেওয়া হল, পরিখাগুলো বুজিয়ে দেওয়া হল। শব্দ-নিবারক পাঁচিল ব্যাফলওয়াল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল। লালকেল্লায় বন্দি হল আজাদ হিন্দ ফৌজ।

“অমনি মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠল মার কাছে শেখা গান”— লেখক কী গান শুনেছিলেন মায়ের কাছ থেকে ? কোন্ প্রসঙ্গে এই উক্তি করেছেন লেখক ?

পদাতিকের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কলের কলকাতা’ রচনা অবলম্বনে দেখা যায় যে, লেখক যে গান তাঁর মায়ের কাছ থেকে ছেলেবেলায় শুনেছিলেন সেটি হল: “ও তোর শিকল পরা ছল। শিকল পরে শিকলরে তুই করবি রে বিকল।”

লেখকদের বাড়িওয়ালা রামদুলালবাবুর দাদার অনুরোধে লেখক একবার জেলে যান গ্রেফতার হওয়া তাঁদের বাড়িওয়ালা, কংগ্রেস কর্মী রামদুলালবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে গিয়ে লেখক দেখেন, ভ্যানের কয়েদিদের সমবেত ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিতে জেলখানার কম্পমান অবস্থা। জেলখানায় ঢুকে একটু এগিয়ে বাঁ-দিকের শেষ ঘরের চেয়ারে বসে আছেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র। সেই সময় লেখক আরও লক্ষ করেন, জেলের ভেতরে থাকা বন্দিরা জালের জানলায় জেল ওয়ার্ডারদের চোখ এড়িয়ে মাঝে মাঝে এসে ভিড় করছিল লেখকদের দেখতে।

এমন সময় জানলার ভেতর থেকে একজন কয়েদি ‘শোনো খোকা বলে লেখককে ডাকে। লেখককে লোকটি তার বাড়ির নম্বর দিয়ে অনুরোধ করে লেখক যেন তার বৃদ্ধা মায়ের কাছে তার ভালো থাকার সংবাদটুকু পৌঁছিয়ে দেন। কিন্তু অলসতার জন্য সে বাড়িতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি লেখকের। এরপর জেলের দরজা পেরিয়ে বাইরে এসে কেমন যেন হতাশ হয়ে পড়েন লেখক।

তিনি ভাবতে থাকেন রাস্তায় রাস্তায় আন্দোলনরত মানুষগুলো এই যে জেলখানার অন্ধকার গুহায় ঢুকে দিন কাটাচ্ছে, এর প্রতিদানে তারা কী পাবে ? এসময় হঠাৎই লেখকের মনের মধ্যে গুনগুন করে ওঠে মায়ের কাছে শেখা সেই গান “ও তোর শিকল পরা ছল। শিকল পরে শিকলরে তুই করবি রে বিকল।”

“খালি মাঠে সব সময় ভিড়।” ‘কলের কলকাতা’। রচনার লেখক খালি মাঠের ভিড়ে যেসব দৃশ্য দেখেছিলেন, তার বর্ণনা দাও।

‘কলের কলকাতা’ রচনার লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায় খালি মাঠে প্রবেশ করে একদিকের ভিড় অতিক্রম করে ঢুকে দেখেন যে, কাঁধ পর্যন্ত বাবরি চুলের একজন লোক কানে মাকড়ি পরে ম্যাজিক দেখাচ্ছে। মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে মাঝেমধ্যেই সে চিৎকার করে বলছে— “ লেড়কালোক একদফে হাততালি লাগাও।” বকতে বকতে তার শুকনো মুখ দিয়ে ফেনা গড়িয়ে পড়ছে। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, সারাদিন সে কিছু খায়নি। ম্যাজিক শেষ হতেই পয়সা দেওয়ার ভয়ে দর্শকরা দ্রুত সরে পড়ে। মাটিতে পড়ে থাকা দু-চার পয়সা কুড়োতে কুড়োতে অভিশাপ দিতে থাকে জাদুকর।

পকেটে পয়সা না থাকা বালক লেখক সেখান থেকে পালিয়ে যান পাশের ভিড়ে। সেখানে দেখেন যে গায়ে লাল আলখাল্লা, গলায় হাড়ের মালা এবং চোখে একদিক সুতো দিয়ে বাঁধা নিকেলের ফ্রেমের মোটা চশমা পরে একজন দাড়িওয়ালা হাকিম কীসব বলছে। তার সামনে রয়েছে একগুচ্ছ গাছগাছড়া, কাঁচা ছাল-চামড়া, হাড়, নীলগাই-এর চামর এবং কাচের বয়েমে ভরা জোঁক ও বিছে। বড়ো বড়ো অসুখের নাম এবং তার কোন্টার কোন্ ওষুধ—তা জানাচ্ছিল লোকটা।

এক জায়গায় দেখেন যে, একজন লোক কানের খোল পরিষ্কার করতে বসেছে। পাশেই একজন লোক ভাঙা কাচ জোড়বার আশ্চর্য কলাকৌশল প্রদর্শন করছে, যা দেখতে লোক ভেঙে পড়েছে। এক জায়গায় একজন চড়ুই পাখি নিয়ে বসে আছে, যে পাখি মানুষের ভাগ্যগণনা করছে। এভাবেই খালি মাঠে ‘বিচিত্র ব্যাপার চলেছে লম্বা রাস্তাটা জুড়ে’। এই ভিড়ের মধ্য থেকেই কোনো এক লোকের পকেটমারি হয়ে যায়।

কলকাতায় এসে লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায়রা যে পাড়ায় ভাড়াবাড়িতে এসে উঠেছিলেন, সে পাড়াটির বর্ণনা দাও ‘কলের কলকাতা’ রচনা অবলম্বন করে।

‘কলের কলকাতা’ রচনার লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায়রা কলকাতায় এসে উঠেছিলেন নেবুতলার ভাড়াবাড়িতে। সংকীর্ণ এক গলির মধ্যে ছিল বাড়িটি। সে বাড়ির চারপাশে ছিল প্যাকিং বাক্সের মতো গাদা গাদা বাড়ি। একটা বাড়ির সঙ্গে আর-একটা বাড়ি যেন আঠা দিয়ে জোড়া। পাড়ার কানাগলির মোড়ে দোতলা-সমান উঁচুতে মালার মতো ঝুলত টেলিফোনের একগুচ্ছ তার। আর সেই কানাগলির মোড়ের বাঁ দিকের বাড়ির সামনে রাতে টিমটিম করে জ্বলত গ্যাসের আলো। সেই আলোর ঠিক নীচে ছিল একটি মিষ্টির দোকান। ডানদিকে ছিল কর্পোরেশনের স্কুল।

সেই স্কুলের সামনের বড়ো একটা রোয়াকে পাড়ার বুড়োরা আড্ডা দিত। একটু এগিয়ে ছিল একটি দর্জির দোকান, যে দর্জির একটা পা ছিল কাটা। পাড়ার ছেলেছোকরারা সে দোকানে আড্ডা দিত। পাড়াটিতে বিভিন্ন পেশার মানুষ বাস করতেন। কেউ ডাক্তার, কেউ কবিরাজ, কেউ লোহালক্কড়ের দোকানদার, কেউ সোনারুপোর দোকানি, কেউ সওদাগরি অফিসের চাকুরে, কেউ ছিল পেশাগতভাবে বাড়িওয়ালা। লেখকদের বাড়িওয়ালা কর্পোরেশনে চাকুরি করতেন। ডাক্তারবাবুর ভাই ছিলেন রেলের ক্যানভাসার। কবিরাজ মশাইয়ের ছোটো ছেলে ছিল বিলেতফেরত। পাড়ার আড্ডি পরিবারের এক ছেলে টাকা জাল করে জেল খাটছিল।

ভোরবেলায় রোদ্দুর পাড়ার গলির মধ্যে তেমন প্রবেশ না করলেও কলের জলের এবং বাসন মাজার শব্দে এবং কাকের পরিত্রাহি চিৎকারে ঘুম ভেঙে যেত পাড়ার লোকেদের। আর বিকেল হলেই পাড়ার ছেলেরা ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে যেত। মাঝে মাঝেই তাই বিকট চিৎকার শোনা যেত—‘ভোঁ-কাটা’। এ পাড়াতেই বেশ কয়েক বছর কাটিয়েছিলেন লেখকরা।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কলের কলকাতা’ রচনা অবলম্বন। করে লেখকের জেলখানা ভ্রমণের বর্ণনা দাও।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কলের কলকাতা’ রচনায় আমরা দেখি যে, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ইংরেজ পুলিশের হাতে বন্দি হওয়া লেখকদের বাড়িওয়ালা রামদুলালবাবুকে দেখতে তাঁর দাদার সঙ্গে জেলে গেছিলেন বালক লেখক। লেখকরা ট্রাম থেকে নেমে জেলখানার সিংহদুয়ার অতিক্রম করে জেলের সিপাই-এর কাছে চিঠি পেশ করেন। কিছুক্ষণ পর জেলে ঢোকার অনুমতি পেয়ে মাথা নীচু করে জেলের ভেতর ঢোকেন তাঁরা। তাঁরা যখন ভিতরে ঢুকছিলেন, তখন একটি কয়েদি ভ্যান জেলের সামনে এসে উপস্থিত হয়। সেই ভ্যানের কয়েদিদের ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিতে জেলখানা কেঁপে ওঠে।

জেলখানায় ঢুকে একটু এগিয়ে বাঁ-হাতে শেষে যে ঘর, সেই ঘরেই সবাই কয়েদিদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করে। ঘরটিতে ঢুকে লেখক দেখেন যে, মেঝের ওপর সতরঞ্চি পাতা। লোকে-লোকারণ্য সেই ঘরে একটিমাত্র চেয়ার-টেবিল রয়েছে। আর সেই চেয়ারে যিনি বসে আছেন, তাকে দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না লেখক। তিনি স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু। এক-একটি কয়েদি ভ্যান আসছিল, আর তিনি সেই ঘর থেকে ছুটে বাইরে বেরিয়ে নবাগতদের জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন—“তোমরা এসেছ ?”

জেলের ভেতরে থাকা বন্দিরা জালের জানলায় মাঝে মাঝে এসে ভিড় করছিল এসব দেখতে। জানলার ভেতর থেকে একজন কয়েদি বালক লেখককে ‘শোনো খোকা’ বলে ডাকে। লেখক কাছে গেলে সে তাঁকে জানায় যে, তার বৃদ্ধা মা তার জন্য কেঁদে একশর হচ্ছে। লেখক যেন তার মাকে গিয়ে খবর দেন, সে ভালো আছে। লোকটি তার বাড়ির নম্বরও জানিয়ে দেয়।

জেল থেকে ফেরার সময় জেলের অন্ধকার গুহায় থাকা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা এবং দেশের স্বাধীনতার কথা ভেবে লেখক হতাশ হয়ে পড়লেও তাঁর মার শেখানো এই গানটি গাইতে গাইতে তিনি তাজা হয়ে ওঠেন—’ও তোর শিকল পরা ছল। শিকল পরে শিকলরে তুই করবি রে বিকল’।

কলকাতা থেকে মোনা ঠাকুররা সাত তাড়াতাড়ি কেন ফিরে এসেছিল, তা ‘কলের কলকাতা’ রচনার অন্তর্গত মোনা ঠাকুরের ভাষ্য অবলম্বন করে লেখো।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কলের কলকাতা’ রচনায় আমরা দেখি যে লেখকের গ্রামের বালক মোনা ঠাকুর কালীঘাটে পইতে নিতে কলকাতায় গিয়ে সপরিবারে এক ধর্মশালায় উঠেছিল। মোনার নিজস্ব ভাষ্য অনুযায়ী, পইতে নেওয়ার পর হঠাৎ একদিন তারা দেখে যে খেপে উঠেছে কলকাতা। শহরের বাড়িগুলোর দরজা-জানালা দ্রুত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

বাড়িগুলো তাই ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। বাড়িগুলোর বড়ো বড়ো দালানগুলি তখন যেন একেবারে হানাবাড়ি। রাস্তাঘাট শুনসান। শহরে মানুষজন আছে কিনা তা বোঝাই যাচ্ছে না। অন্ধকার রাতে মাঝে মাঝেই প্রবল চিৎকার কানে ভেসে আসে—“হা রে রে রে রে রে! মুসলমানগুলোকে কাটব। হা রে রে রে রে! হিন্দুগুলোকে কাটব।” প্রকাশ্য রাস্তায় শুরু হয়ে যায় দাঙ্গা। প্রত্যেকের হাতেই লাঠি বা ছুরি। রক্তের স্রোত বয়ে যায় রাস্তায়। পথে লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। ঘরবাড়িতে শুরু হয় আগুন ধরানো।

সাহেবদের অবশ্য কোনো ভয় নেই এই দুঃসময়েও। হিন্দু বা মুসলমান—কেউই তাদের স্পর্শ করে না। যাইহোক, এই দাঙ্গা দেখে ধর্মশালায় থাকা যাত্রীরা স্বভাবতই অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রাণ নিয়ে যেভাবেই হোক পালাতে চায় তারা, মোনারাও। তারা চলে গেলে পান্ডাদের উপার্জনের ব্যাঘাত ঘটবে বলে কালীঘাটের পান্ডারা তাদের কলকাতা ত্যাগ করতে নিষেধ করে। অভয় দিয়ে জানায় যে, তারা থাকতে যাত্রীদের কোনো ভয় নেই।

কিন্তু সে কথা ধর্মশালাবাসীরা শোনে না। খ্যাপা শহর কলকাতা। কখন যে কী হয়—কিছু বলা যায় না। এসব ভেবে তারা কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ছ্যাকড়া গাড়ি পর্যন্ত তারা ভাড়া করে না। এক রাতের অন্ধকারে মোনা ঠাকুররা নিঃশব্দে কলকাতা থেকে বিদায় নেয়। এভাবেই মোনা ঠাকুররা সাত তাড়াতাড়ি কলকাতা থেকে বিদায় নিয়েছিল।

September 2023
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930  

Leave a Reply