You are currently viewing আল-মামুনের চরিত্র ও কৃতিত্ব | bnginfo.com
মামুনের চরিত্র ও কৃতিত্ব | bnginfo.com

আল-মামুনের চরিত্র ও কৃতিত্ব | bnginfo.com

৭ম আব্বাসীয় খলিফা “আল-মামুন” পুরো নাম “আবু জাফর আবদুল্লাহ আল মামুন ইবনে হারুন“।

আস-সাফ্ফাহ  AS-SAFFAH | ১ম আব্বাসীয় খলিফা

আবু জাফর আল-মনসুর (৭৫৪-৭৭৫ খ্রিঃ) ২য় আব্বাসীয় খলিফা

  • আল-মামুন (১৯৮–২১৮ হিঃ ৮১৩-৮৩৩ খ্রিঃ)
  • চরিত্র :-
  • মামুনের রাজ্যভার গ্রহণ :-
  • বিদ্রোহ দমন :-
  1. মেসোপটেমিয়া ও মিশরে বিদ্রোহ দমন
  2. ইয়েমেনে ও খোরাসানে বিদ্রোহ দমন
  3. তাহিরী বংশের প্রতিষ্ঠা
  4. দস্যু বাবেক
  • রাজ্য বিস্তার :-
  1. সিসিলি বিজয়
  2. ক্রীট জয়
  3. পূর্বাঞ্চল জয়
  4. বুরানের সাথে মামুনের বিবাহ
  • মামুনের ধর্মমত :-
  • মনোনয়ন দান :-
  • কৃতিত্ব :-
  1. শাসক হিসেবে আল-মামুন
  2. কৃষিকার্য ও শিল্পের উন্নতি
  3. স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠায় মামুন
  4. ধর্মীয় স্বাধীনতা
  • শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে :-
  1. সর্বক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ
  2. শিক্ষার সম্প্রসারণ
  3. কাগজের উৎপাদন
  4. জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি
  5. সাপ্তাহিক শিক্ষা আলোচনার বৈঠক
  6. বিভিন্ন গ্রন্থের অনুবাদ
  7. বায়তুল হিকমা
  8. মানমন্দির প্রতিষ্ঠা
  9. দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার
  10. সাহিত্য, ইতিহাস ও ধর্ম-দর্শন
  11. হস্তলিপি
  12. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ
  13. ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণযুগ
  • মৃত্যু :-

আল-মামুন (১৯৮–২১৮ হিঃ ৮১৩-৮৩৩ খ্রিঃ)

আবু জাফর আবদুল্লাহ আল মামুন ইবনে হারুন। (সেপ্টেম্বর ৭৮৬ – ৯ আগস্ট ৮৩৩) তিনি ছিলেন ৭ম আব্বাসীয় খলিফা।

৮১৩ সাল থেকে ৮৩৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শাসন করেন। আল আমিন নিহত হওয়ার পর তিনি খিলাফত গ্রহণ করেন।

৮১৩ খ্রিস্টাব্দে অন্তর্বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধের মধ্যে আল-মামুন খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর রাজ্যলিপ্সার চেয়ে জ্ঞানস্পৃহাই ছিল অধিক।

তাই রাষ্ট্রের শাসনভার প্রধানমন্ত্রী ফজল-বিন-সাহলের উপর ন্যস্ত করে তিনি খোরাসানের রাজধানী মার্তে দার্শনিক আলোচনায় আত্মনিয়োগ করলেন। তাঁর রাজত্বকালকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যায়,

যথাঃ (ক) ৮১৩৮১৯ খ্রিস্টাব্দ এবং (খ) ৮১৯৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ। রাজত্বের প্রথম ছয় বছর প্রধানমন্ত্রী ফজল-বিন-সাহল রাজকার্য পরিচালনা করেন।

ছয় বছর পর খলিফা মামুন স্বহস্তে শাসনভার গ্রহণ করেন।

চরিত্র :-

খলিফা মামুন ছিলেন সুঠাম ও সুশ্রী দেহের অধিকারী। তাঁর চরিত্রে নানাহ গুণের সমাবেশ ঘটেছিল।

তিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, আইনবিদ, যোগ্য নরপতি ও দক্ষ সেনাপতি ছিলেন।

কর্মক্ষমতা, নম্রতা, ন্যায়পরায়ণতা ও উদারতা তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল।

শাসনদক্ষতা, বিচক্ষণতা ও বিদ্যোৎসাহিতার দিক দিয়ে বিচার করলে তাঁকে আব্বাসীয় বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ খলিফা বলা যায় এবং

তৎকালীন বিশ্বের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতিদের অন্যতম হিসেবে পরিগণিত করা যায়।

ব্যক্তিগতভাবে তিনি খুব ধার্মিক ছিলেন। সমগ্র কুরআন শরীফ তাঁর মুখস্থ ছিল।

কথিত আছে, রমজান মাসে তিনি কুরআন শরীফ তেত্রিশবার খতম করতেন।

হাদিসেও তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল, তাঁর ন্যায় মহানুভব ব্যক্তি বিশ্বের ইতিহাসে খুব বিরল।

জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর প্রজা তাঁর চক্ষে সমান ছিল।

তাঁর চরিত্র সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে আমীর আলী একজন আরব ঐতিহাসিকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন,

তাঁর প্রজ্ঞা, দৃঢ় সংকল্প, দয়া ও সুবিচার, অপূর্ব বুদ্ধিমত্তা ও ত্রাস সঞ্চারকারী প্রকৃতি, তাঁর নির্ভীকতা,

রাজকীয় মহিমা ও বদান্যতার জন্য তিনি আব্বাসীয় বংশের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন।

তাঁর অনেক উল্লেখযোগ্য গুণ ছিল। তাঁর সম্বন্ধে বহু স্মরণীয় ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

আব্বাসীয় বংশের মধ্যে তাঁর চেয়ে জ্ঞানী আর কেউ খিলাফত পরিচালনা করেন নি।”

মামুনের রাজ্যভার গ্রহণ :-

মানুষ রাজধানীতে ফিরে এসে রাজ্যের উন্নতির দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি সর্বপ্রথম বাগদাদের সংস্কার সাধন করেন।

অতঃপর তাঁর সেনাপতি তাহিরের হস্তে খোরাসানের শাসনভার ন্যস্ত করেন এবং আবদুল্লাহ্ নামে তাহিরের এক পুত্রকে মিশরের শাসনকর্তা পদে নিযুক্ত করেন। মামুন সকল ধর্মের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন।

জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলে তাঁর রাজ্যে সমান অধিকার ভোগ করত।

বিদ্রোহ দমন :-

১। মেসোপটেমিয়া ও মিশরে বিদ্রোহ দমন :- খলিফা মামুন আবদুল্লাহ্-বিন-তাহিরকে সিরিয়া ও মিশরের সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলেন।

তিনি লোক হিসেবে খুব দয়ালু ছিলেন। নসর উকায়লী মেসোপটেমিয়ায় বিদ্রোহী হলে আবদুল্লাহ্ তাঁকে পরাজিত ও বন্দী করে খলিফার

নিকট পাঠিয়ে দিলেন (৮২২ খ্রিঃ)। মেসোপটেমিয়ায় শান্তি স্থাপন করে আবদুল্লাহ্-বিন-তাহির মিশরের দিকে রওনা হলেন। সেখানেও তিনি বিদ্রোহীদের দমন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেন।

২। ইয়েমেনে ও খোরাসানে বিদ্রোহ দমন :- মামুনের আমলে ইয়েমেন ও খোরাসানে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ইব্রাহীম ইয়েমেনে এবং

আবদুর রহমানের নেতৃত্বে খারিজিগণ খোরাসানে বিদ্রোহ ঘোষণা করে অরাজকতার সৃষ্টি করে। ইয়েমেনের বিদ্রোহ সহজেই দমন করা হয়।

কিন্তু খোরাসানের বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করলে খলিফা সেনাপতি তাহির-বিন-হুসাইনকে সেখানে প্রেরণ করেন।

তাহির খোরাসানে গিয়ে এ বিদ্রোহ দমন করে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।

৩। তাহিরী বংশের প্রতিষ্ঠা :- ৮২৩ খ্রিস্টাব্দে তাহির পূর্বাঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন।

তিনি খোরাসানে স্বীয় বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নামানুসারে এ বংশের নাম হয় ‘তাহিরী বংশ’।

এ বংশের পাঁচজন শাসক (তাহির, তানহা, আবদুল্লাহ, দ্বিতীয় তাহির ও মুহাম্মদ) পর পর ২৪৮ হিজরি পর্যন্ত রাজত্ব করেন।

খুতবা হতে খলিফার নাম বাদ দিলেও তাহির মামুনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন।

এ সময়ে (৮২৩ খ্রিঃ) কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির নেতৃত্বে খলিফা মামুনকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে।

প্রধান ষড়যন্ত্রকারীদের সমুচিত শাস্তি দেয়া হয়; কিন্তু সাধারণ লোকদেরকে ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়।

৪। দস্যু বাবেক :- মামুনের রাজত্বের প্রথমদিকে মাজেন্দ্রানে বাবেক নামে এক দস্যু সর্দার অনুচরসহ আজারবাইজানে

একটি ঘাঁটি তৈরি করে রাজ্যের উত্তরাংশে ব্যাপক লুটতরাজ আরম্ভ করে। বাবেক আত্মার স্থানান্তর গমনে (Transmigration of soul)

বিশ্বাস করত এবং মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের ধর্মের কোন নৈতিক অনুশাসনই স্বীকার করত না।

সে কয়েকবার রাজকীয় বাহিনীকে পরাজিত করেছিল এবং রোমান সম্রাট থিউফিলাসকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করত।

৫। রোমানদের পরাজয় :- এ মিলিত শক্তিকে জব্দ করার জন্য মামুন স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন এবং উপর্যুপরি তিনটি অভিযান

পরিচালনা করে শত্রুর ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে চূর্ণ করে দিলেন। রোমানগণ সন্ধি করতে বাধ্য হলো।

রোমানদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য তিনি ভায়ানাতে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের আদেশ দিলেন এবং নিজেই এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন।

রাজ্য বিস্তার :-

১) সিসিলি বিজয় :- খলিফা মামুন রাজ্য বিস্তার অপেক্ষা শান্তি স্থাপনেরই বেশি পক্ষপাতী ছিলেন।

তবে প্রয়োজনের তাগিদে কয়েকটি অভিযান প্রেরণ করেন ৮৮২৩ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার শাসনকর্তা জিয়াতুল্লাহ্ আগলার সিসিলি

দ্বীপ খলিফার কর্তৃত্বাধীনে আনয়ন করেন। এ সময়ে স্পেনের উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় আবদুর রহমান স্পেন হতে বহু আরব বিদ্রোহীকে বিতাড়িত করে দেন।

২। ক্রীট জয় :- এ বিদ্রোহীগণ মিশরে এসে বসতি স্থাপন করে; কিন্তু তারা সেখানকার শাসনকর্তার জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

মিশরের শাসনকর্তা আবদুল্লাহ্-বিন-তাহির তাদেরকে অন্যত্র চলে যাবার নির্দেশ দিলে তারা ক্রীট দ্বীপে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে এবং

তাদের আবেদন মঞ্জুর করা হয়। প্রত্যাগমনের সময় যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে তাদের সাহায্য করা হলো। এ সাহায্য পেয়ে তারা ক্রীট দ্বীপ জয় করে সেখানে বসতি স্থাপন করল।

৩। পূর্বাঞ্চল জয় :- একই সময়ে কায়রোয়ানের আগলাবীয় শাসনকর্তারা সিসিলি জয় করেন। এমনকি, তাঁরা দক্ষিণ ইতালিতে অবতরণ করেন

এবং রোমের দিকে অগ্রসর হন। এ সময় পূর্বদিকে আফগানিস্তান অঞ্চলে খলিফা মামুনের সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে। তাঁর এক সেনাপত্তি কাবুল সম্রাটকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন।

৪। বুরানের সাথে মামুনের বিবাহ :- ৮২৬ খ্রিস্টাব্দে মামুন তাঁর উজির হাসান-বিন-সাহলের সর্বগুণসম্পন্না কন্যা বুরানকে বিবাহ করেন।

এ বিবাহোৎসব অত্যন্ত জাঁকজমক ও শান-শওকতের সাথে সম্পন্ন হয়। কথিত আছে, এ বিবাহ উপলক্ষে বরযাত্রীগণকে আপ্যায়িত করতে উজিরের পাঁচ কোটি দিরহাম ব্যয় হয়েছিল।

পি. কে. হিট্টি বলেন, “এ বিবাহে এত অধিক অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল। যা আরব সাহিত্যে সে যুগের একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা।”

রাজকীয় বায় নির্বাহের জন্য খলিফা হাসানকে ফারস ও আহওয়াজের এক বছরের রাজস্ব প্রদান করেছিলেন।

খলিফার উপর মহিষী ইরানের যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। তাঁর প্রচেষ্টায় রাজ্যে কয়েকটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়।

মামুনের ধর্মমত :-

খলিফা মামুন ধর্ম সম্বন্ধে উদার মত পোষণ করতেন। তিনি পরিবর্তনশীল জগতে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনে সচেষ্ট হন। তাঁর সময় মু’তাযিলা সম্প্রদায় রাষ্ট্রে বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করে।

‘মু’তাযিলা’ শব্দের অর্থ যে সমাজ ছেড়ে চলে গিয়েছে (One who has seceded from the society)।

মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ওয়াসিল-বিন-আতা। তিনি একদিন তাঁর ধর্মগুরু হাসান আল বসরীর সাথে কোন বিষয়ে মতানৈক্য হওয়ায় পৃথক মতবাদ গ্রহণ করেন। তাঁর মতাবলম্বীদেরকে মু’তাযিলা বলা হয়।

মু’তাযিলা সম্প্রদায় সকল তত্ত্ব ও তথ্য বিচার-বুদ্ধি, যুক্তি ও তর্কের দ্বারা যাচাই করে গ্রহণ করত। মুতাযিলাদের মতে, মানুষ ভাল-মন্দ বিচারে স্বাধীন;

আল্লাহর গুণাবলি (Attributes) তাঁর অস্তিত্ব হতে পৃথক নয় এবং কুরআন শরীফ সৃষ্ট। সুতরাং কুরআন তাঁদের মতে অনাদি নয়।

জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি এবং ইসলামের মঙ্গলের জন্য যুক্তিবাদী খলিফা মামুন মু’তাযিলা মতবাদ গ্রহণ করে তাকে রাজধর্মে পরিণত করেন।

মৃত্যুর দু’বছর পূর্বে (৮৩১ খ্রিঃ) মামুন বিচারক ও ইসলামী ধর্মতত্ত্বের বিশারদদের ডেকে মু’তাযিলা মতবাদের উপর তাদের বিশ্বাস যাচাই করার জন্য বাগদাদের গভর্নরের নিকট একটি নির্দেশ পাঠান।

মু’তাযিলা মতবাদ গ্রহণ করতে যারা অস্বীকার করলেন তাদের শান্তি দেয়া হলো। কথিত আছে, অধিকাংশ ব্যক্তিই এটা গ্রহণ করলেন,

কিন্তু সুন্নী সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মনেতা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের নেতৃত্বে কুড়িজন আলেম এ মতবাদের বিরোধিতা করলে তাঁদের কারারুদ্ধ করা হয়।

মনোনয়ন দান :-

মামুনের রাজনৈতিক পদ্ধতি আল-মামুন যে রাজনৈতিক পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন তা তাঁর উদার ও সহিষ্ণু মনোভাবের পরিচয় বহন করে।

তিনি তাঁর পিতা হারুনের মত স্বেচ্ছাচারী স্বৈরাচার ছিলেন না। এদিক হতে তাঁর পারসিক মতবাদ (ইরানিবাদ) তাঁকে স্বেচ্ছাচারী স্বৈরাচারে

পরিণত করে নি। পক্ষান্তরে, তিনি ইসলামের নিরাপত্তা ও মুসলমানদের সম্মতি নিশ্চিত করে তাঁর শাসনব্যবস্থাকে ন্যায়সঙ্গত করার চেষ্টা করেছেন।

কৃতিত্ব :-

১। শাসক হিসেবে আল-মামুন :- আব্বাসীয় বংশের, এমনকি সমগ্র মুসলিম জাহানের একজন শ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন।

তিনি শুধু রাজ্য জয় করেই ক্ষান্ত হন নি তিনি একে সুদৃঢ়ও করেন। মামুন একজন প্রতিষ্ঠাবান শাসক ছিলেন। তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর প্রজাকে ভালবাসতেন এবং তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য স্বীকার করতেন না। তিনি যোগ্যতানুসারে প্রজাকে রাজপদে নিযুক্ত করতেন।

মামুন তাঁর অধীনে সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নিয়ে একটি রাষ্ট্র পরিষদ (Council of State) গঠন করেছিলেন। এতে মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টান, সার্বিয়া ও জোরোস্টীয়গণ স্থান পেয়েছিল।

শাসনকার্য পরিচালনার ব্যাপারে এ পরিষদ খলিফাকে সাহায্য করত। সকল ধর্মের প্রতি তিনি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন এবং সকলকে পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দান করেছিলেন।

তিনি যুক্তিবাদী মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকলেও স্বধর্মের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় আস্থা ছিল।

২। কৃষিকার্য ও শিল্পের উন্নতি :- মামুন একজন বিচক্ষণ শাসনকর্তা ছিলেন। প্রজাদের আর্থিক ও পারমার্থিক মঙ্গল সাধনই ছিল তাঁর শাসনের মূল লক্ষ্য। তাঁর শাসনামলে প্রজারা সুখে শান্তিতে বাস করত।

তিনি প্রজাদের মঙ্গলের জন্য জমি জরিপ, খাল খনন ও জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর আমলে শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষিকার্যে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছিল।

৩। স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠায় মামুন :- খলিফা আল-মামুন অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, যথার্থ শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চার মধ্যেই জনসাধারণের কল্যাণ নিহিত।

জ্ঞানের বিকাশের প্রক্রিয়া কোন একক খলিফা কিংবা মহান আমীরের বদান্যতার উপর নির্ভরশীল হোক, তা তিনি চান নি।

জ্ঞানের প্রতি যথার্থ মর্যাদাবোধের কারণে তিনি একে আকস্মিক দান-অনুদানের বাইরে এসে এর বিকাশের জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা প্রবর্তনের উপর জোর দিয়েছিলেন।

তাঁর আমলে সাম্রাজ্যের সর্বত্রই স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠিত এবং এগুলোকে ব্যাপকভাবে স্থায়ী অনুদানের আওতায় আনা হয়েছিল।

৪। ধর্মীয় স্বাধীনতা :- খলিফা আল-মামুন সকল সম্প্রদায়কে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেছিলেন। কথিত আছে যে, ১১,০০০ খ্রিস্টান গির্জা, ইহুদিদের অনেক উপাসনালয় এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মন্দির তাঁর সাম্রাজ্যের সর্বত্র বিদ্যমান ছিল।

মামুনের নিরপেক্ষ ও উদার শাসনে সন্তুষ্ট হয়ে খারিজিগণ এ আমলে কোন গণ্ডগোল সৃষ্টি করে নি।

একদা জনৈক খারিজি দলপতি খলিফার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তাঁকে কতিপয় প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন।

এক প্রশ্নের উত্তরে খলিফা বলেন যে, যদি তারা একমত হয়ে কাউকেও খলিফা পদে মনোনীত করে তাহলে তিনি তাঁর অনুকূলে পদত্যাগ করবেন।

খলিফা মামুনের জবাবে খারিজি নেতা সন্তুষ্ট হয়ে “তাঁর উপর আল্লাহর শান্তি, দয়া ও আশীর্বাদ বর্ষিত হোক” বলে চলে গেলেন।

এ সব কার্যাবলি হতে শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে মামুনের মহানুভবতার পরিচয় পাওয়া যায়।

শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে :-

১। সর্বক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ :- শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মামুনের স্থান ইসলামের ইতিহাসে অদ্বিতীয়।

তাঁর উদার পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এক অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল।

আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুর ও হারুন-অর-রশীদ জ্ঞান বিজ্ঞান ও সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার যে পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন, মামুনের প্রচেষ্টায় তা পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়।

ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, “মামুনের খিলাফত সারাসিনীয় ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় এবং একে যথার্থভাবে ইসলামের ‘অগাস্টান যুগ’ বলা হয়েছে।

তাঁর বিশ বছরব্যাপী শাসনকাল চিন্তাধারার প্রত্যেক ক্ষেত্রে মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তির পরিবর্ধক স্থায়ী স্মৃতিচিহ্ন রেখে গিয়েছে।

শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মুসলমানদের এ সাফল্য বিজ্ঞান বা সাহিত্যের কোন বিশেষ শাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, এটা বুদ্ধিবৃত্তির যাবতীয় ক্ষেত্রে প্রসার লাভ করেছিল।

২। শিক্ষার সম্প্রসারণ :- আল-মামুন ছিলেন মানবতায় বিশ্বাসী। মানবাত্মার শান্তির জন্য তিনি শিক্ষা ও সংস্কৃতির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করতেন।

তাঁর দৃষ্টিতে রাজ্যজয় অপেক্ষা সাংস্কৃতিক বিজয় অনেক বেশি মূল্যবান। তাই সাংস্কৃতিক চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য তিনি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করেছিলেন।

এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রচুর অর্থ মঞ্জুরির ব্যবস্থা ছিল; অনেক লাখেরাজ সম্পত্তিও দান করা হয়েছিল।

এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক ওয়েলসনার বলেন, “আমরা পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত সর্বপ্রথম দেখতে পাই যে,

একটি ধর্মীয় ও স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে সখ্যতায় আবদ্ধ হয়ে এর উন্নতি বিধানে সব রকম প্রস্তুতি ও অংশগ্রহণ করছে।”

৩। কাগজের উৎপাদন :- শিক্ষা ও সংস্কৃতির সম্প্রসারণের জন্য মামুন শুধু স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হন নি,

তিনি এর ব্যাপক বিস্তৃতির জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাও গ্রহণ করেন। শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রসারের প্রধান বাহক হলো কাগজ।

হিজরির তৃতীয় শতাব্দীতে কিছু চীনা কাগজ ইরাকে আমদানি হয়; কিন্তু তা অনতিবিলম্বে দেশীয় শিল্পে রূপলাভ করে।

খলিফা হারুনের সময় যে কাগজকল প্রতিষ্ঠিত হয় তার উৎপাদন এ সময় বৃদ্ধি পায়। খলিফা মামুনের রাজত্বকালে প্রচুর কাগজ উৎপাদনের ফলে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে।

৪ । জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি :- মামুনের উদার পৃষ্ঠপোষকতায় সাহিত্য, কাব্য, দর্শন, ইতিহাস, গণিত, জ্যোতিষশাস্ত্র, চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয় চরম উৎকর্ষতা লাভ করেছিল।

মামুন ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ছিলেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দার্শনিক ও যুক্তিনির্ভর।

পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও বিভিন্ন জাতির পণ্ডিত, কবি, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, চিকিৎসাবিদ এবং অপরাপর বিষয়ের মনীষীগণ তাঁর দরবারে জমায়েত হয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করতেন।

এ সমস্ত পণ্ডিতের অবদানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। অধ্যাপক হিট্টি বলেন, “বিশ্বের ইতিহাস এ যুগকে বিশেষভাবে গৌরবোজ্জ্বল করেছে;

কারণ ইসলামের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তির জাগরণ ও চিন্তাধারার বিকাশ লাভ করে এ যুগে। এ সময়ই সৃষ্টির ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয়।”

৫। সাপ্তাহিক শিক্ষা আলোচনার বৈঠক :- প্রত্যেক মঙ্গলবার রাজদরবারে শিক্ষা আলোচনার জন্য বৈঠক বসত এবং এতে বিভিন্ন সাহিত্যিক, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক যোগদান করতেন।

প্রসিদ্ধ হাদিস সংগ্রাহক ইমাম বুখারী, ফারসি কবি আব্বাস, ঐতিহাসিক ওয়াকিদী, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ-বিন-হাম্বল, দার্শনিক আল-কিন্দী, খ্রিস্টান চিকিৎসাবিদ কুসটা-বিন-লিউক

এবং হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জীবনী লেখক ইবনে হিশাম এ আমলে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাঁদের উপস্থিতি তাঁর রাজত্বকালের গৌরব বৃদ্ধি করেছিল।

৬। বিভিন্ন গ্রন্থের অনুবাদ :- মনসুরের আমলে আরবিতে বিদেশী গ্রন্থের যে অনুবাদ কাজ শুরু হয়, মামুনের রাজত্বকালে তা সুসংগঠিত হয় ও বিশ্বজননীর রূপ লাভ করে।

মামুনের প্রচেষ্টায় এথেন্স, আলেকজান্দ্রিয়া, সিরিয়া, এশিয়া মাইনর প্রভৃতি স্থান হতে বহু মূল্যবান প্রাচীন গ্রন্থ সংগৃহীত হয়।

পশ্চিমে হারুন-অর-রশীদের সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে লুণ্ঠিত মালামালের মধ্যে কয়েকটি গ্রিক গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিও খলিফার হস্তগত হয়।

আসুরিয়া ও আঙ্কারা হতে প্রাপ্ত পাণ্ডুলিপিগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গ্রিক গ্রন্থসমূহের খোঁজে খলিফা আল-মামুন সুদূর কনস্টান্টিনোপল এবং আর্মেনীয় সম্রাটের দরবারের দূত প্রেরণ করেন।

এ গ্রন্থসমূহ প্রথমে সিরীয় এবং পরে সিরীয় হতে আরবি ভাষায় অনূদিত হয়।

বিভিন্ন পণ্ডিতদের উপর এগুলো অনুবাদ করার ভার অর্পিত হয়। প্রাচীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দার্শনিক এরিস্টটল, প্লেটোর পুস্তকগুলো এবং গ্যালেন, ইউক্লিড, টলেমি প্রমুখ মনীষীবৃন্দের বৈজ্ঞানিক গ্রন্থাবলি আরবিতে অনূদিত হয়।

গ্রিক, সিরীয় ও কালদীয় ভাষায় লিখিত গ্রন্থসমূহের অনুবাদ করার ভার ছিল লিউকের পুত্র কুসটার উপর।

ইয়াহ্ইয়া-বিন-হারুনের উপর পারস্য ভাষায় লিখিত গ্রন্থ এবং দুবান নামে একজন ব্রাহ্মণের উপর সংস্কৃত ভাষায় লিখিত গ্রন্থের অনুবাদের ভার ন্যস্ত ছিল। অনুবাদকারীদেরকে গ্রন্থের ওজনে স্বর্ণমুদ্রা পারিশ্রমিক দেয়া হত।

এসব অনুবাদকের সাহায্যে মামুন গ্রিক পণ্ডিতগণের আজীবনের সাধনা ও গবেষণার ফল অক্ষুণ্ণ রাখেন।

ইবনে আবি উসাইবিয়াহ এবং আল-কিফতী গ্রিক দার্শনিকদের কমপক্ষে ১০০টি অনূদিত পুস্তকের উল্লেখ করেছেন। ইউরোপ যখন গ্রিক চিন্তা ও বিজ্ঞান সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে নিমজ্জিত তখন আরবে এ কার্য সম্পাদিত হয়েছিল।

এ সম্বন্ধে উইলিয়াম মূর বলেন, “এ পণ্ডিতগণের পরিশ্রমের ফলে মধ্যযুগের অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপীয় জাতিগুলো তাদের নিজস্ব অথচ লুপ্ত ধন প্রাচীন গ্রিসের বিজ্ঞান ও দর্শনের সাথে পুনরায় পরিচিত হয়েছিল।

৭। বায়তুল হিকমা :- ‘বায়তুল হিকমা’ বা জ্ঞান-নিকেতনের (House of Learning) প্রতিষ্ঠা ছিল খলিফা আল-মামুনের স্মরণীয় কৃতিত্বের অন্যতম।

গ্রিক, সংস্কৃত, পারস্য, সিরিয়া প্রভৃতি ভাষায় লিখিত পুস্তকাদির অনুবাদ কার্যকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে খলিফা মামুন বাগদাদ নগরীতে এটা প্রতিষ্ঠা করেন।

এতে তিনটি বিভাগ ছিল— গ্রন্থাগার, শিক্ষায়তন ও অনুবাদ কার্যালয়। হুনায়ান ইবনে ইসহাক নামে একজন সুপণ্ডিতকে এ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করা হয়। আরববাসীরা হুনায়ানকে ‘অনুবাদকের শেখ’ বলে।

এ অনুবাদক সে যুগের সর্বাপেক্ষা বড় পণ্ডিত এবং সর্বাপেক্ষা মহান ছিলেন।

তাঁর চেষ্টায় এরিস্টটল, গ্যালেন, প্লেটো, হিপোক্রাটস প্রমুখ পণ্ডিতের গ্রন্থ অনূদিত হয়ে আরবি সাহিত্যের মারফতে দেশ-বিদেশে প্রচারিত হয়। মুসলমানগণ অনুবাদকের দ্বারা এ সমস্ত বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিতের গবেষণা রক্ষা না করলে পৃথিবী হতে তা বিলুপ্ত হয়ে যেত।

কিন্তু মুসলমান পণ্ডিতগণ শুধু অনুবাদের কার্য করেই ক্ষান্ত হন নি, তাঁরা তাঁদের তর্জমার সাথে নিজস্ব অবদানও সিরিয়া, স্পেন ও সিসিলি মারফত ইউরোপে পৌঁছে দেন।

মুসলমানগণ প্রাচীন মানবসভ্যতার শুধু ধারকই ছিলেন না, তাঁরা ইউরোপে নবজাগরণ সৃষ্টিতেও যথেষ্ট অবদান রেখে গিয়েছেন।

৮ । মানমন্দির প্রতিষ্ঠা :- আল-মামুনের আমলে অনুবাদ কার্যাদির সাথে সাথে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়েও প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়।

জ্যোতির্বিদ্যা গবেষণার জন্য তিনি সর্বপ্রথম শামশিয়াতে একটি মানমন্দির (Observatory) স্থাপন করেন।

জ্যোতির্বিদ্যায় মুসলমানেরা এতদূর উৎকর্ষতা লাভ করেছিলেন যে, তাঁরা গ্রহ, ধূমকেতু প্রভৃতি বিষয়ে বহু মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করেন।

এ সম্বন্ধে ঐতিহাসিক জে. ডব্লিউ ড্রাপার বলেন, “আরবগণ নভোমণ্ডলে যে অমলিন হস্তস্থাপ রেখেছেন, তা যে কোন লোক ভূমণ্ডলের নক্ষত্র সম্বন্ধীয় জ্ঞান আহরণের সময় উপলব্ধি করতে পারবেন।

৯। দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার :- এতদ্ব্যতীত, অঙ্ক, জ্যামিতি, রসায়ন, বায়ুবিজ্ঞান, যন্ত্রবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, দর্শন, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ও এ আমলে চরম উৎকর্ষতা লাভ করেছিল।

আবুল হাসান নামে একজন বৈজ্ঞানিক এ সময় টেলিস্কোপ (দূরবীক্ষণ যন্ত্র) আবিষ্কার করেন। দূরবীক্ষণ ছিল একটি নল (Tube) বিশেষ।

এর উভয় প্রান্তে আলোর প্রতিফলন রয়েছে। এ নলের উৎকর্ষ সাধিত হয়ে এটা পরবর্তীকালে কৃতকার্যতার সাথে কায়রো ও মারাগার মানমন্দিরে ব্যবহৃত হয়েছিল।

১০। সাহিত্য, ইতিহাস ও ধর্ম-দর্শন :- আল-মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় সাহিত্য, ইতিহাস ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধেও অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছিল।

মৃতপ্রায় ফারসি সাহিত্য এ সময় নবজীবন লাভ করে। কবি আব্বাস ফারসি কবিতার জনক ছিলেন। তিনি মামুনের রাজসভার একজন সদস্য ছিলেন।

মামুন তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। আবু আল-আতাহিয়া ধর্মীয় কবিতা রচনা করে সুখ্যাতি অর্জন করেন।

ইতিহাস রচনায় এ যুগে আল-ওয়াকিদীর নাম সুপরিচিত ছিল। ইসলামের বিজয়কে কেন্দ্র করে তিনি একটি মূল্যবান ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচনা করেন।

হিশাম আল-কালৰী প্ৰাক্-ইসলামী যুগ সম্পর্কে মূল্যবান ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে খলিফা মামুনের পাণ্ডিত্য ছিল।

ধর্মতত্ত্ব, হাদিস ও আইনশাস্ত্রের আলোচনাকে তিনি উৎসাহিত করতেন এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় এসব বিষয়ের চর্চা অবাধ গতিতে চলতে থাকে। হাদিস সংগ্রহকারী হিসেবে ইমাম বুখারীর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল।

তিনি ১৬ বছর ধরে বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করে ৬০ লক্ষ হাদিস সংগ্রহ করেন এবং এর মধ্যে মাত্র ৭,২৭৫টি হাদিসকে নির্ভুল বলে গ্রহণ করেন। এ যুগে ধর্ম-দর্শনের উপর আরও অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছিল।

১১। হস্তলিপি :- আল-মামুনের রাজত্বকালে সুকুমার শিল্পচর্চার ক্ষেত্রেও বিশেষ উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। এ সম্বন্ধে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বলেন, “মুসলমানগণ যে সকল শিল্পের চর্চা করতেন, তার মধ্যে হস্তশিল্পই ছিল সর্বাধিক রুচিসম্মত।” মামুনের শাসনামলে আর-রায়হানী একজন প্রখ্যাত লিপিকার ছিলেন। তাঁর নামানুসারে একটি লিখন পদ্ধতির নাম হয় ‘রায়হানী’।

১২। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ :- সংস্কৃতির বিকাশের সাথে সাথে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির গুরুত্বকে খলিফা মামুন অবহেলা করেন নি।

এ কারণে মামুন ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্পোৎপাদনকেও উৎসাহিত করেছিলেন। পি. কে. হিট্টি বলেন, “সম্ভবত আল-মামুনের রাজধানী বাণিজ্য, শিল্পোন্নয়ন ও জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে

গৌরব অর্জন করেন যা উত্তর ব্যবিলন হতে তেলিফোন পর্যন্ত নির্মিত সমৃদ্ধশালী রাজধানীগুলোর যোগ্য উত্তরাধিকারী ছিল।

১৩। ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণযুগ :- আল-মামুনের রাজত্বকালে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল তা বিবেচনা করে অনেক ঐতিহাসিক একে ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণযুগ (The Golden Age of Islamic Civilization) বলে অভিহিত করেছেন।

আবার অনেকে মামুনের রাজত্বকালকে রোম সম্রাট অগাস্টানের সাথে তুলনা করেছেন। সম্রাট অগাস্টানের সময় রোমান সাম্রাজ্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে যেমন উচ্চাসন লাভ করেছিল,

তেমনি খলিফা মামুনের সময় আরব সভ্যতা উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মামুনের শাসনামল অগাস্টানের যুগ (Augustan Age) অপেক্ষা ও উজ্জ্বল ও গৌরবময় ছিল।

এ সম্পর্কে জনৈক ঐতিহাসিক বলেছেন, “শুধু ইসলামের ইতিহাসেই নয়, বিশ্বের ইতিহাসেও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এমন অভূতপূর্ব জাগরণ ও উন্নতি আর পরিলক্ষিত হয় না।

মৃত্যু :-

মৃত্যুর পূর্বে খলিফা মামুন পিতা কর্তৃক মনোনীত প্রার্থী ভ্রাতা কাসিম এমনকি, জ্যেষ্ঠ পুত্র আব্বাসকে বঞ্চিত করে

অপেক্ষাকৃত যোগ্য ও দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী অপর ভ্রাতা আবু ইসহাক মুহাম্মদকে ‘মুতাসিম বিল্লাহ’ উপাধি দিয়ে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান।

আবু ইসহাক মুহাম্মদ সে সময় খলিফার সাথে ভারসাসে ছিলেন। মামুন তারসাসের ৭০ মাইল উত্তরে তারানা নামক স্থানে একটি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের কার্য ওদারক করছিলেন। ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তারসাসে প্রাণত্যাগ করেন।

  • communication of barriers

    Type of Barriers Communication: Examples Definition and FAQs

  • কলের কলকাতা : সুভাষ মুখোপাধ্যায়,”আমার বাংলা”- bnginfo.com

    মেঘের গায়ে জলখানা : সুভাষ মুখোপাধ্যায়,”আমার বাংলা”- bnginfo.com

  • কলের কলকাতা : সুভাষ মুখোপাধ্যায়,”আমার বাংলা”

    কলের কলকাতা : সুভাষ মুখোপাধ্যায়,”আমার বাংলা”- bnginfo.com

  • 'ছাতির বদলে হাতি' সুভাষ মুখোপাধ্যায়

    ছাতির বদলে হাতি : সুভাষ মুখোপাধ্যায়,”আমার বাংলা”- bnginfo.com

Leave a Reply