প্রশ্নঃ- আব্বাসী বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা কাকে এবং বলা হয় কেন ? বিস্তারিত আলোচনা কর।
উত্তরঃ- (সংক্ষিপ্ত)
ভূমিকা:- আব্বাসী বংশের পথম খলীফা আবুল আব্বাস আব্দুল্লাহ্ সাফ্ফার মৃত্যুর পর ৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে ভ্রাতা আবু জাফর মনসূর
খিলাফতের সিংহাসনে আরোহন করেন। ফলে আব্বাসীয় ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। আবুল আব্বাস সাফ্ফার নিষ্ঠুরতার
কারণে দেশে চরম গোলযোগ সৃষ্টি হয়েছিল এবং বিভিন্ন জায়গায় বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। খলীফা মনূর সিংহাসনে বসার পর অত্যন্ত বিচক্ষণতা
ও দূরদর্শিতার সাথে বিদ্রোহগুলি দমন করেন এবং দেশকে সন্ত্রাসমুক্ত করে ভাবীকালের জন্য একটি সুদৃঢ় ও সমৃদ্ধশালী প্রশাসনিক কাঠামো
গঠন করেন এবং খিলাফতের ভিতকে মজবুত করেন। যার ফলে আব্বাসী বংশ সুদীর্ঘ পাঁচশত বছর স্হায়িত্ব লাভ করেছিল।
আর, সেই কারণেই খলীফা মনসূরকে আব্বাসী বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। নিম্নে তার আলোচনা করা হল।
সুন্নী ধর্মমত প্রতিষ্ঠা:- খলীফা আবু জাফর মনসূর খিলাফতে সম্মান বৃদ্ধির জন্য সুন্নী ধর্মহত প্রতিষ্ঠা করেন এবং ধর্মীয় অনুশাসনের
সাথে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্হার সমন্বয় সাধন করে পার্থিব ও আধ্যাত্মিক উভয় ক্ষেত্রে খিলাফতের বুনিয়াদকে শক্তিশালী করেন।
ন্যায়-নিষ্ঠা কায়েম:- খলীফা আবু জাফর মনসুর ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও ন্যায়-নিষ্ঠাবান। তিনি সকল শ্রেণির প্রজাদের মধ্যে ইনসাফ’
কায়েম করেন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং সমস্ত জনসাধারণ কে ঐক্যবদ্ধ কে খিলাফতের ভিত্তিকে
সুদৃঢ় ও মজবুত করেছিলেন। আর, এই সকল গুণাবলীর জন্যই তাঁকে আব্বাসী বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলে গণ্য করা হয়।
বিদ্রোহ দমন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা:-আবু জা’ফর মনসূর খলীফা পদে শপথ নেওয়ার পরই, খিলামতের অন্যতম দাবিদার পিতৃবা আব্দুল্লাহ বিদ্রোহ
ঘোষণা করেন। ফলে ৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে নাসিবীনের যুদ্ধে আব্দুল্লাহকে পরাজিত করে বন্দি করেন এবং পরে তাকে হত্যা করে সাম্রাজ্যকে
কন্টকমুক্ত করেন। আবু মুসলিম খোরাসানী পারস্যবাসীদের উপর রহস্যময় ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
যা দেখে খলীফা মনুরের মনে ভয় ও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল যে, অদূর ভবিষ্যতে আব্বাসী খিলাফত সে ছিনিয়ে নিতে পারে। তাই, কালবিলম্বি না
করে খলীফা আবু জাফর মনসূর আবু মুসলিমকে হত্যা করেন এবং সম্ভাব্য বিপদ থেকে মুক্ত হন। পারস্যের বিদ্রোহী নেতা সানবাদের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং তাকে পরাজিত করে হত্যা করেন। রাওয়ান্দিয়া সম্প্রদায়ের বিদ্রোহকে কঠোর হস্তে দমন করেন। এমনিভাবে দেশের
বিভিন্ন প্রান্তের বিদ্রোহী ও দুর্বৃত্তদের চরম শাস্তি দিয়ে নিরাপত্তা কায়েম করেন এবং দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে আব্বাসী বংশ
সু-দৃঢ় প্রসারী হয়।
প্রশাসনিক সংগঠন:– খলীফা আবু জাফর মনসুর জনসাধারণের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ বাহিনী। গঠন করেন। তাছাড়া, কাজির পদ বহাল,
গুপ্তচর প্রথার বর্তন, জমি জরিপ এবং আদম শুমারী বন্দাবস্ত করেন।
রাজ্য বিস্তার:- খলীফা আবু জাফর মনসুর ৭৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যণত প্রায় বাইশ বছরের রাজত্বকালে সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া,
প্যালেস্টাইন, খোরাসান, এশিয়া মাইনর, জিয়া, মসুল দামেশক প্রাভৃথি বিশাল রাজ্য জয় করেছিলেন এবং স্পেন ও আফ্রিকার কিয়দাংশ ব্যতীত
সমগ্র আরব সম্রাজ্যে আব্বাসীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার সঙ্গে সমগ্র আরবজারে ঐক্যবদ্ধ করে আব্বাসীয় খিলাফতের ভিত্তিকে সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করেছিলেন। যার কারণে খলীফা আবু জাফর মনসূকে আব্বাসী বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
উপসংহার:- খলীফা আবু জাফর মনসুরের শাসনকাল হল আব্বাসীয় খিলাফতের এক গৌরবময় অধ্যায়। নানা বিপদ ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে
তিনি আব্বাসী সাম্রাজ্যকে সুসংহত ও বিপদমুক্ত করেছিলেন। ফলে আব্বাসী বংশ দীর্ঘস্হায়ী হয়েছিল। তাই বলা ঝায় আবুল আব্বাস এই বংশের প্রথম খলীফা হলেও প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবু জাফর মনসুর।
আবু জাফর আল-মনসুর (৭৫৪-৭৭৫ খ্রিঃ) (বিস্তারিত)
সিংহাসনারোহণ :- আস্-সাফ্ফাহর মৃত্যুর সময় তাঁর ভ্রাতা আবু জাফর হজ্ব উপলক্ষে মক্কায় ছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে ঈসা তাঁকে খলিফা
ঘোষণা করেন। কুফায় ফিরে এসে আবু জাফর ‘আল-মনসুর’ উপাধি গ্রহণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তাঁর সিংহাসনে আরোহণের সাথে সাথে আব্বাসীয় ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো।
বাধা-বিপত্তির মোকাবিলা :- ও আস্-সাফ্ফাহর সকল প্রকার নিষ্ঠুরতা সত্ত্বেও আব্বাসীয় সিংহাসন তখনও সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত ছিল না।
সুতরাং মনসুরের ২১ বছর রাজত্বকাল নানা রকম বিরোধ ও বিদ্রোহের মধ্যদিয়ে অতিবাহিত হয়। এতদসত্ত্বেও মনসুর যুদ্ধ-বিগ্রহ,
বিশ্বাসঘাতকতা ও হত্যাকাণ্ডের দ্বারা এ সমস্ত বিদ্রোহ দমন করে ভাবীকালের জন্য একটি সুদৃঢ়, সমৃদ্ধশালী ও সুষ্ঠু প্রশাসনিক কাঠামো
গড়ে তোলেন। আব্বাসীয় বংশের শাসন সুদৃঢ় করতে তিনি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অধিকতর মনোনিবেশ করেছিলেন ।
তিনি রাজকার্যে নিযুক্ত সকল আত্মীয়-অনাত্মীয়র প্রতি সজাগ দৃষ্টি দেন।
অভ্যন্তরীণ নীতি :- ভবিষ্যতে বিপদের কারণ হতে পারে, এমন ব্যক্তিদের প্রতি তিনি কঠোর মনোভাব গ্রহণ করতেন।
তিনি খিলাফতের সম্মান বৃদ্ধির জন্য সুন্নী ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মীয় ব্যবস্থার সাথে শাসনব্যবস্থার সমন্বয় সাধন করে তিনি পার্থিব ও
আধ্যাত্মিক উভয়ক্ষেত্রেই খলিফার সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিলেন। আল-মনসুরের অভ্যন্তরীণ নীতি খিলাফতের ভিত্তি ও জনগণের
ঐক্যবন্ধনকে সুদৃঢ় করেছিল। তাই আস-সাফ্ফাহ্ এ বংশের প্রথম খলিফা হলেও মনসুরকে আব্বাসীয় খিলাফতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা
হিসেবে গণ্য করা হয়। তাঁর শাসনকাল আব্বাসীয় খিলাফতের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
আল-মনসুরের শাসনকাল :- আল-মনসুরের শাসনকালকে সাধারণত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা: (১) বিদ্রোহ দমন,
(২) রাজ্যবিস্তার ও (৩) প্রশাসনিক ব্যবস্থার সংগঠন।
বিদ্রোহ দমন:-
আব্দুল্লাহ-বিন-আলীর বিদ্রোহ। খলিফা হিসেবে আল-মনসুরের ক্ষমতা গ্রহণের পরেই -বিন-আলী সর্বাগ্রে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
তিনি ছিলেন সিরিয়ার শাসনকর্তা ও আল আবদুল্লাহ্-বি মনসুরের পিতৃব্য। পূর্ববর্তী খলিফা আস-সাফ্ফাহর রাজত্বকালে
আবদুল্লাহ-বিন-আলী মারওয়ানের বিরুদ্ধে জাবের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কথা ছিল, যুদ্ধে জয়ী হলে আস্-সাফ্ফাহ তাঁকে খিলাফতের উত্তরাধিকারী মনোনীত করবেন।
নাসিবিনের যুদ্ধ, ৭৫৪ খ্রিঃ আবদুল্লাহর বিদ্রোহ দমনের জন্য খলিফা আবু মুসলিমকে প্রেরণ করেন। ১৭ হাজার সৈন্য নিয়ে আবদুল্লাহ্
প্রতিপক্ষের মোকাবিলার জন্য অগ্রসর হলেন। নাসিবিন প্রান্তরে উভয় দলে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হলো (নভেম্বর, ৭৫৪ খ্রি.)। যুদ্ধে আবদুল্লাহ্
শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে পেরে উঠতে পারলেন না।
আবু মুসলিমের পতন :
আব্দুল্লাহ-বিন-আলীর পরাজয়ের পর খলিফা খোরাসানের শাসনকর্তা আবু মুসলিমের দিকে নজর দিলেন।
আবু মুসলিম খোরাসানে যে প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তার করেছিলেন তা মনসুরের ভয় ও ঈর্ষার কারণ হয়ে পড়ে।
আবু মুসলিমের হত্যা। অবশেষে তিনি খলিফার সাথে দেখা করতে গেলে তাঁকে রাজকীয় মর্যাদায় অভ্যর্থনা জানান হয়।
কিন্তু পরের দিন সাক্ষাতের সময় খলিফা তাঁকে আবদুল্লাহ্ বিন-আলীর নিকট হতে প্রাপ্ত লুণ্ঠিত দ্রব্যের কথা জিজ্ঞাসা করেন এবং ইবনে কাথিরের
হত্যার জন্য তাঁকে অভিযুক্ত করেন। অতঃপর রাগান্বিত খলিফা হাতে তালি দেয়ার সাথে সাথে পাঁচজন সশস্ত্র লোক আবু মুসলিমের উপর
ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে হত্যা করে। এভাবে যে লোকটি এতদিন ধরে বিশ্বস্ততার সাথে আব্বাসীয় বংশের খেদমত করছিলেন তাঁর জীবনাবসান হলো।
বাস্তবিকপক্ষে আবু মুসলিম সম্পর্কে খলিফা মনসুরের সন্দেহের কোন কারণ ছিল না। আবু মুসলিম নিঃসন্দেহে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন;
কিন্তু তিনি তাঁর প্রভুদের প্রতি অবাধ্য হন নি।
আবু মুসলিমের কৃতিত্ব :- ইসলামের ইতিহাসে আবু মুসলিম একজন খ্যাতনামা ব্যক্তি। ইস্পাহানের এক নগণ্য পরিবারে তাঁর জন্ম হলেও
স্বীয় প্রতিভাবলে তিনি সাম্রাজ্যের একজন রাজসংস্থাপক (King-maker) হয়ে উঠেছিলেন। উমাইয়া বংশের পতন ঘটিয়ে আব্বাসীয়দের
ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। আব্বাসীয় বংশকে ক্ষমতায়
প্রতিষ্ঠিত করতে তাঁর দান ছিল অপরিসীম। ঐতিহাসিক উইলিয়ম মূর বলেন, “মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে তিনি তাঁর অসাধারণ
বুদ্ধিমত্তা, কর্মতৎপরতা ও রণনৈপুণ্য দ্বারা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বদলিয়ে দিয়েছিলেন এবং উমাইয়া বংশের ধ্বংসস্তূপের উপর আব্বাসীয়
বংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
বাগদাদ নগরীর প্রতিষ্ঠা :- আলী সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ দমনের পর খলিফা আল-মনসুর একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের পরিকল্পনা
গ্রহণ করেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি একটি উপযুক্ত স্থানে একটি শক্তিশালী রাজধানী স্থাপনের সচেষ্ট হন। তিনি খলিফা আল-আব্বাসের প্রতিষ্ঠিত
রাজধানীকে (হাশিমীয়া শহর) সাম্রাজ্যের রাজধানীর জন্য নিরাপদ মনে করেন নি। কারণ এ শহর সিরিয়া ও কুফার মধ্যস্থানে অবস্থিত ছিল।
ফলে আলী সম্প্রদায়ের আক্রমণের আশঙ্কা হতে এটা নিরাপদ ছিল না। রাজধানী হিসেবে দামেশকও নিরাপদ ছিল না।
অন্যান্য বিদ্ৰোহ :- ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে হিরাতের শাসনকর্তা উত্তাদসীস (Ustadsis) বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এমনকি, তিনি নিজেকে নবী হিসেবেও
দাবি করেছিলেন। খোরাসান ও সিজিস্তানের বিরাট এলাকা বিদ্রোহীদের দখলে আসে। বিদ্রোহীরা এত বেশি শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন যে,
খলিফার সেনাবাহিনী বেশ কয়েকবার তাদের কাছে পরাজিত হয়। শেষ পর্যন্ত ইবনে খোজাইমার নেতৃত্বে এ বিদ্রোহ দমন করা হয়।
বিদ্রোহী নেতা উস্তাদসীসকে বন্দী করে বাগদাদে আনা হয়। কথিত আছে, তাঁর কন্যাকে হারুনের সাথে বিবাহ দেয়া হয়,
মামুন এ মহিলারই গর্ভজাত সন্তান।
প্রশাসনিক ব্যবস্থা :-
পারসিক প্রভাব : সাম্রাজ্যে সুশাসন প্রবর্তনের জন্য আল-মনসুর কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে শক্তিশালী করার ব্যবস্থা করেন।
তাঁর প্রচেষ্টার ফলেই আব্বাসীয় খিলাফতের শাসনতন্ত্র সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করেছিল। সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ছাড়াও শাসনব্যবস্থাকে
সুবিন্যস্ত করার প্রয়োজনেই তিনি সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে নতুন রাজধানী নির্মাণ করেছিলেন। এতে শাসনকার্যের তদারক সহজতর হয়।
কিন্তু বাগদাদ প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের সংলগ্ন থাকায় খলিফা মনসুর শাসনব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসে পারসিক রীতিনীতি দ্বারা গভীরভাবে
প্রভাবিত হয়েছিলেন। হিটির কথায়, আরব শেখতন্ত্রের পরিবর্তে খিলাফত ইরানি স্বৈরতন্ত্রের আকার ধারণ করে। খলিফা আল-মনসুরই
সর্ব প্রথম ‘উজির’ পদের সৃষ্টি করেন। শাসনকার্য পরিচালনায় উজির ছিলেন সকল রাজকর্মচারীর শীর্ষে। পারস্যবাসী খালিদ-বিন বার্মাক
প্রধান উজির নিযুক্ত হলে শাসনব্যবস্থায় পারসিক প্রভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ন্যায়বিচার : ন্যায়বিচারের প্রতি আল-মনসুরের সুনজর ছিল। প্রদেশ ও কেন্দ্রীয় রাজধানীতে তিনি যথাক্রমে কাজী ও প্রধান কাজী নিয়োগ করেছিলেন।
তাঁর সময়ে মুহাম্মদ-বিন আবদুর রহমান বাগদাদের প্রধান কাজী হিসেবে প্রায় ২০ বছর বহাল ছিলেন। খলিফা মনসুর নিষ্ঠুর,
বিশ্বাসঘাতক ও স্বেচ্ছাচারী হলেও বিচারব্যবস্থার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল। বিচারকের স্বাধীনতাকে তিনি ক্ষুণ্ণ করতেন না।
জনকল্যাণ : জনগণের কল্যাণের জন্য খলিফা আল-মনসুর, অনেক নৃগর, সরাইখানা, রাস্তাঘাট ও চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন।
এ সময়ে কৃষিকার্যের উন্নতি ও ব্যবসায় বাণিজ্য প্রসারিত হয়। কূপ ও পয়ঃপ্রণালী খনন এবং মাদ্রাসা ও হাসপাতাল স্থাপন
তাঁর কল্যাণকামী রাজত্বকালের পরিচয় বহন করে।
আল-মনসুরের কৃতিত্ব বিচার :-
আব্বাসীয় বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা :- আবুল আব্বাস আস-সাফাহ্ আব্বাসীয় বংশের প্রথম খলিফা ছিলেন বটে;
কিন্তু মনসুর ছিলেন এ বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। এ সম্বন্ধে ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি বলেন, “আস্-সাফ্ফাহর পরিবর্তে বরং তিনিই
(মনসুর) নতুন রাজবংশকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর পর যে পঁয়ত্রিশ জন আব্বাসীয় খলিফা শাসনদও পরিচালনা করেন তাঁরা
সকলেই তাঁর বংশধর। আস-সাফ্ফাহ আব্বাসীয় বংশকে খিলাফতের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সত্য, কিন্তু সময়ের অভাবে সাম্রাজ্যকে
সুসংবদ্ধ করে যেতে পারেন নি। কাজেই মনসুরকে সিংহাসনে আরোহণ করেই নানা বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
অন্তবিপ্লব ও বহিঃশত্রুর হামলা তাঁকে বিপদগ্রস্ত করে তোলে।
এ সময় সাহস ও বিচক্ষণতার সাথে আবদুল্লাহ্-বিন-আলীর বিদ্রোহ, সানবাদের নেতৃত্বে পারস্যের বিদ্রোহ, ধর্মদ্রোহী রাওয়ান্দিয়া সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ,
হিরাতের শাসনকর্তা উদ্ভাদসীসের বিদ্রোহ ও অন্যান্য বিদ্রোহের মোকাবিলা করতে না পারলে সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব বিপন্ন হত। তিনি দৃঢ়হস্তে রাজ্যের
এ সমস্ত বিদ্রোহ দমন করে যে কর্মনিষ্ঠা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা আব্বাসীয় ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তিনি সাম্রাজ্যকে বিপদমুক্ত ও সুসংগঠিত করে এর ভিত্তি সুদৃঢ় করেছিলেন। কঠোর হস্তে সকল প্রকার বিদ্রোহ দমন করে রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপন,
রাজ্যজয় করে সাম্রাজ্যের সীমানা সম্প্রসারণ এবং সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করে এর স্থায়িত্ব বিধান আল মনসুরের বিরাট কৃতিত্ব।
স্বীয় যোগ্যতা দ্বারা তিনি আব্বাসীয় খিলাফতের ভিত্তিকে এমন সুদৃঢ় করে গিয়েছেন যা আব্বাসীয় শাসনামলকে প্রায় সাত বছর স্থায়িত্ব দান করেছিল।
বিজেতা :- খলিফা মনসুর সাম্রাজ্যকে আসন্ন ধ্বংসের হাত হতে শুধু রক্ষাই করেন নি, তিনি এর সম্প্রসারণেরও মধ্যবস্থা করেছিলেন।
তাঁর প্রচেষ্টার ফলে আব্বাসীয় সাম্রাজ্য তাবারিস্তান, দায়লাম, কুর্দিস্তান, উত্তর আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে বিস্তার লাভ করে। তিনি রোমান
সম্রাটকে পরাজিত করে কর দানে বাধ্য করেন। তিনি সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য সীমান্ত এলাকায় সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণেরও ব্যবস্থা করেন।
রাজনৈতিক প্রজ্ঞা :- রাজনীতিবিদ হিসেবে আল-মনসুর ছিলেন অসামান্য দূরদর্শিতার অধিকারী। তিনি খলিফার পার্থিব ক্ষমতার ক্ষণস্থায়িত্ব
সম্বন্ধে অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। তাই আব্বাসীয় খিলাফতের স্থায়িত্ব বিধানের জন্য তিনি খলিফার পবিত্র ক্ষমতার সাথে আধ্যাত্মিকতার
সংযোগ সাধন করেন। তিনি ধর্মনেতার মর্যাদা লাভের উদ্দেশ্যে সুন্নি মতবাদের ভিত্তি গড়ে তোলেন।
হানাফি ও মালেকি মাযহাব গঠনেও তিনি উৎসাহ যোগান। এ প্রচেষ্টা দ্বারা একদিকে তিনি যেমন ধর্মগুরুর মর্যাদা লাভ করেন, অন্যদিকে
তেমনি সুন্নি মতবাদের সাহায্যে শিয়া মতবাদকে প্রতিহত করার সুযোগ লাভ করেছিলেন। খিল্মফতের সাথে ধর্মীয় পবিত্রতার সংযোগ
সাধনের ফলে পরবর্তীকালে খলিফাগণ ক্ষমতাহীন হলেও ধর্মীয় মর্যাদা হারান নি। প্রকৃতপক্ষে, মনসুরই আব্বাসীয় খিলাফতের শাসনতন্ত্র রচনা করেন।
সুযোগ্য শাসক :- খলিফা মনসুর যোগ্য, উদ্যমশীল, বিবেচক ও মিতব্যয়ী শাসক ছিলেন। তিনিই আব্বাসীয় শাসনব্যবস্থার রূপরেখা গড়ে তুলেছিলেন।
তিনি নিজেই রাষ্ট্রের কার্য দেখাশুনা করতেন। রাষ্ট্রের রাজস্বের ব্যাপারে খলিফা খুব সজাগ ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে
হিসাব-নিকাশ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করতেন। এ জন্য তাঁর উপধি ছিল ‘আবুদ্দাওয়ানিক’ (The father of the penny)।
তিনি কৃষিকার্যের উন্নতি এবং শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার সাধন করে সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছিলেন।
তিনি প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের প্রতি কড়া নজর রাখতেন।
পুলিশবাহিনী সৃষ্টি, গুপ্তচর প্রথা প্রবর্তন, কাজী নিয়োগ, জমি জরিপ ও আদমশুমারির ব্যবস্থা, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে উৎসাহ দান প্রভৃতি কার্যকলাপ
শাসক হিসেবে তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় দেয়। তাঁর কৃতিত্বের মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমীর আলী বলেন, “রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক এবং শাসক
হিসেবে আল-মনসুর এক প্রকার অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তিনি প্রজাসাধারণের মঙ্গলের জন্য বহু নগর, সরাইখানা, হাসপাতাল, মসজিদ,
মাদ্রাসা ও রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং অনেক কূপ ও পয়ঃপ্রণালী খনন করেন। ঐতিহাসিক মূরের মতে, “মোটামুটিভাবে তাঁর শাসনব্যবস্থা
বিচক্ষণতা ও ন্যায়পরায়ণতার সাক্ষ্য বহন করে।”
চরিত্র :-
ঐতিহাসিক আমীর আলীর ভাষায়, আবু জাফরের চরিত্র ছিল অদ্ভুতভাবে দোষগুণের সংমিশ্রণ। তিনি মিত্রের প্রতি যেমন ছিলেন কোমল,
শত্রুর প্রতি তেমনি ছিলেন নির্মম ও নিষ্ঠুর। পিতা হিসেবে সন্তানবৎসল হলেও মানুষ হিসেবে তিনি বিশ্বাসঘাতক ও নৃশংস হত্যাকারী ছিলেন।
আবু মুসলিম ও আবদুল্লাহ্-বিন-আলীর প্রতি তাঁর অমানুষিক ব্যবহার আব্বাসীয় বংশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে রয়েছে।
এ সম্পর্কে উইলিয়াম মূর বলেন, “তাঁর সমস্ত সদগুণ থাকা সত্ত্বেও বিশ্বাসঘাতক ও নিষ্ঠুর মানুষ হিসেবে ইতিহাসের রায় মনসুরের বিরুদ্ধে
যাবেই।”
যে আলী বংশের লোকদের সহযোগিতায় ও প্রচারণায় আব্বাসীয় বংশ ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে বংশের নেতৃবৃন্দ মুহাম্মদ ও ইব্রাহীমকে
নৃশংসভাবে হত্যা করে মনসুর ইতিহাসে এক জঘন্যতম উদাহরণ স্থাপন করেছেন। ঐতিহাসিক সুযুক্তি বলেন, “মনসুর সর্ব প্রথম আব্বাসীয় ও
আলী পন্থীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেন। কারণ, এর পূর্বে তারা সংঘবদ্ধ ছিল।” কিন্তু মনসুরের চরিত্র ঐতিহাসিকরা যেভাবে চিত্রিত করেছেন,
সময় ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে খলিফার চরিত্র তত খারাপ ছিল না। নব প্রতিষ্ঠিত আব্বাসীয় খিলাফতের শত্রু ছিল অনেক এবং
তারা খুব শক্তিশালী ছিল।
এ সময়ে তিনি কঠোর ও রক্তপাত নীতি (Policy of blood and iron) গ্রহণ না করলে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যকে শত্রুদের হাত হতে রক্ষা করতে
পারতেন না। ব্যক্তি স্বার্থ অপেক্ষা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ তাঁর কাছে তখন বড় ছিল। তা আব্বাসীয় খিলাফতের স্বার্থ রক্ষার জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে মনসুর
নিষ্ঠুর হতে বাধ্য হয়েছিলেন। মানবিক। অন্যায় হলেও রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি এটা করার ন্যায়সঙ্গত দাবি রাখেন।
যে ঐতিহাসিক মনসুরকে বিশ্বাসঘাতক ও নিষ্ঠুর বলে অভিহিত করেছেন তিনিই আবার বলেন, “যদি আমরা তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার দিকটি ভুলে যাই,
তাহলে মনসুর সম্বন্ধে আমাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা হবে।”
মুসলমান হিসেবে আল-মনসুর ধার্মিক ও আদর্শ স্থানীয় ছিলেন। কোন রকম অপবিত্রতা তাঁর দরবারে দেখা যায় নি। ন্যায়পরায়ণতা ছিল তাঁর
চরিত্রের ভূষণ। কথিত আছে, একদা কতিপয় উষ্ট্রের মালিকের অভিযোগক্রমে তিনি সাধারণ আসামীরূপে কাজীর দরবারে উপস্থিত হতে
দ্বিধাবোধ করেন নি। বিচারের তিনি দোষী সাব্যস্ত হন; কিন্তু নিরপেক্ষ বিচারের জন্য তিনি কাজীকে পুরষ্কৃত করেন।
- B.A.SR.M (FAZIL)
- Bengali
- Books
- Exam Result
- General Topics
- Geography
- History
- Holiday
- Islamic history
- Math
- Political science
- Theology
- প্রবন্ধ ও রচনা
- Type of Barriers Communication: Examples Definition and FAQs
- BOLDEPOTA AMINIA SENIOR MADRASAH (FAZIL)
- মেঘের গায়ে জলখানা : সুভাষ মুখোপাধ্যায়,”আমার বাংলা”- bnginfo.com
- কলের কলকাতা : সুভাষ মুখোপাধ্যায়,”আমার বাংলা”- bnginfo.com
- ছাতির বদলে হাতি : সুভাষ মুখোপাধ্যায়,”আমার বাংলা”- bnginfo.com
History
Good vibes
I benefited, thank you bro