আব্বাসীয় বংশের পতনের কারণ (সংক্ষিপ্ত)
প্রাকৃতিক নিয়ম:- ঐতিহাসিক ইবনে খালদুনের মতে যে কোনো রাজবংশের স্থিতিকাল একশ বছর, সূচনা, বিকাশ ও
পতন একশত বৎসরের মধ্যে ওই তিনটি নির্দিষ্ট নিয়ম অতিক্রম করে অবশেষে পতনের দিকে ধাবিত হয়।
বলা বাহুল্য একশ বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই আব্বাসীয় শাসন পতনের জগতে পাড়ি দেয়।
আব্বাসীয় শাসকদের অযোগ্যতা :- আব্বাসীয় খেলাফতের মোট ৩৭ জন আব্বাসীয় খলিফার মধ্যে আবুল আব্বাস আল মানসুর,
হারুন রশিদ ও মামুন ছাড়া বেশির ভাগ শাসকই ছিলেন অযোগ্য ও অকমর্ন্য। তাদের অযোগ্যতা আব্বাসীয় খেলাফতের পতনের জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
বিলাস বহুল জীবন ও চরিত্রহীনতা :- আব্বাসীয় খলিফাদের মদ্যে মামুন এর পরবর্তী খলিফাগণ চরিত্রহীন ও আরামপ্রিয় ছিলেন।
তারা সাম্রাজ্যের প্রজাদের প্রতি নজর না দিয়ে ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে থাকতেন। মদ্যপান, ক্রীতদাস ও রক্ষিত ছিল তাদের জীবনের নিত্য সঙ্গী, ফলে বিলাস বহুল জীবন যাপনএ রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়।
উত্তরাধিকার নীতির অভাব :- আব্বাসীয় খেলাফত কোন সৃষ্ঠ উত্তরাধিকারী নীতি না থাকায় পতনের দিকে এগিয়ে যায়।
যখনই একজন খলিফা পদ ত্যাগ করতেন সিংহাসন লাভের জন্য একাধিক ব্যক্তি সংঘর্ষে লিপ্ত হত। এই খিলাফতকে কেন্দ্র করে আমিন ও মামুনের মধ্যে যে রক্তক্ষয়ি সংঘর্ষ হয়েছিল তা এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সাম্রাজ্যের বিশালতা :- সাম্রাজ্যের বিশালতা আব্বাসীয় বংশের পতনের অন্যতম কারণ। তাদের সাম্রাজ্যের সীমা এত বেশী বৃদ্ধি
পেয়েছিল যে কেন্দ্র থেকে সকল অঞ্চল সুষ্ঠুভাবে শাসন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
ঐতিহাসিক কারণ :- কোন সাম্রাজ্যই দীর্ঘ সময় ধরে রাজত্ব করতে পারে না। যার সৃষ্টি আছে তার ধ্বংস অনিবার্য।
বিশ্বের সকল রাজবংশই ধ্বংসশীল। সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই ঘটে সে বিষয়ে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের মত এক বিরাট সাম্রজ্যের পতন কোন আশ্চর্য ঘটনা নয়।
মোঙ্গলদের আক্রমণ :- উপরোক্ত কারণগুলিতে আব্বাসীয় খেলাফত বিধ্বস্ত তখন তাদেরকে একেবারেই ছুটির ঘণ্টা বাজায়, বৈদেশিক আক্রমণ।
১২৫৮ সালে মোঙ্গলনেতা হালাকুখান বাগদাদ আক্রমণ ও ধ্বংস করে এবং শেষ আব্বাসীয় খলিফা মুসাতাসিমকে
সপরিবারে হত্যা করলে এই সাম্রাজ্যের চিরপতন ঘটে।
উপসংহার :- পরিশেষে বলা যায়, প্রবল শৌর্য বীর্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও শেষদিকের | আব্বাসীয় খলিফাগণ অত্যাচারী হয়ে ওঠে।
অযোগ্যতা, অদক্ষতা, অভ্যন্তরীণ বিবাদ ঝগড়া, ভোগ বিলাস রাজকোষ আত্মসাৎ ইত্যাদি কারণে তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
আব্বাসীয় বংশের পতনের কারণ (বিস্তারিত)
প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম :- জন্য, বিকাশ ও বিনাশ – এ তিনটি প্রকৃতিরই অমোঘ নিয়ম। ব্যক্তির জীবনে এটা যেমন সত্য,
সাম্রাজ্য বা রাজবংশের ক্ষেত্রেও এটা তেমনি একইভাবে প্রযোজ্য। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই পৃথিবীতে তাই কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়।
ইবনে খালদুন একটি রাজবংশের স্থায়িত্বকে একশত বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছেন, এর পরেই শুরু হয় অবনতি ও পতনের পালা।
আব্বাসীয় খিলাফতকেও প্রকৃতির এ চিরন্তন বিধানকে মেনে নিতে হয়েছিল। বাহ্যিক দৃষ্টিতে আব্বাসীয় খিলাফত পাঁচ শতাধিক
(৭৫০-১২৫৮ খ্রিঃ) বছর স্থায়ী হলেও এর অবক্ষয়ের সূচনা হয়। খলিফা ওয়াসিকের শাসনামলের (৮৪২-৮৪৭ খ্রিঃ) পরেই।
প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে আব্বাসীয় খিলাফতের পতন ঘটলেও এর পশ্চাতে অন্যান্য কারণও ছিল।
খলিফাদের অযোগ্যতা :- আব্বাসীয় বংশের অধিকাংশ খলিফাদের অযোগ্যতাই এ বংশের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ।
এ বংশের সর্বমোট ৩৭ জন খলিফার মধ্যে প্রথম কয়েকজন বিশেষ করে আল-মনসুর, হারুন-অর-রশীদ ও আল-মামুন যোগ্য ও সুশাসক ছিলেন। তাঁরা অসাধারণ শাসন দক্ষতা ও বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু মুতাসিমের পরবর্তী অধিকাংশ খলিফা অযোগ্য, অকর্মণ্য ও দুর্বল ছিলেন।
তাঁরা রাষ্ট্রের মঙ্গলের চিন্তা না করে ভোগবিলাসে মত্ত থাকতেন। এ সম্বন্ধে পি. কে. হিট্টি আল তাহলিবির (Al-Tahalibi) একটি উক্তি উদ্ধৃত করেছেন,
“আব্বাসীয় খিলাফতের গৌরবের সূচনা করেন আল-মনসুর, আল-মামুন এটাকে পরিপূর্ণ করেন এবং আল-মুতাজিদ এর বিনাশ ঘটান।”
অযোগ্য ও বিলাসী উত্তরাধিকারীদের শাসনামলে সাম্রাজ্য ব্যাপক অসন্তোষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে ।
স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিরা এ পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে। এভাবে সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে।
সাম্রাজ্যের বিশালতা :- আব্বাসীয় খিলাফত আমলে পূর্ব ও পশ্চিম দিকেও সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে।
আব্বাসীয় সাম্রাজ্য আটলান্টিক মহাসাগর হতে নীলনদ এবং কাস্পিয়ান সাগর হতে নীলনদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
মোঙ্গল সাম্রাজ্যের ন্যায় এতবড় সাম্রাজ্য শাসন করা দুর্বল খলিফাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে যুগে যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল অনুন্নত।
দূরবর্তী অঞ্চলে বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হত না। ফলে কালক্রমে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে
বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব আত্মপ্রকাশ করে।
বিভিন্ন স্বাধীন রাজবংশের উদ্ভব :- বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করার মত যোগ্যতা ও বিচক্ষণতা পরবর্তী আব্বাসীয় খলিফাদের ছিল না।
তাঁদের অযোগ্যতার কারণে সাম্রাজ্যে বিদ্রোহীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। মন্ত্রিদের স্বেচ্ছাচারিতা ও কুশাসনে গণঅসন্তোষ মাথাচাড়া দেয়।
এ পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে স্বার্থপর সুযোগ সন্ধানীরা স্বমূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করে। দুর্বল শাসকবর্গ তাদের প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়।
হিট্টির কথা, “রোগী আগেই মৃত্যুশয্যায় শায়িত ছিল; সিঁদেল চোর টের পেয়ে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢোকে এবং রাজকীয় সম্পত্তি হতে নিজ
নিজ অংশ কেড়ে নেয়। ” কাজেই শাসকবর্গের দুর্বলতার সুযোগে ইদ্রিসীয়, সামানীয়, বুয়াইয়া, গজনভী, সেলজুক,
ফাতেমীয় প্রভৃতি ছোট ছোট স্বাধীন রাজবংশের উদ্ভব হলে সাম্রাজ্যের ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন হয়।
খলিফা মুতাসিম তুর্কীদের নিয়ে একটি স্বতন্ত্র সেনাদল গঠন করেছিলেন। পরবর্তীকালে তুর্কী সৈন্যদের প্রাধান্য আব্বাসীয়
বংশের পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তুর্কীবাহিনী কালক্রমে সাম্রাজ্যের সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিয়েছিল।
খলিফাদের উপরও তারা প্রভুত্ব করত তুর্কীদের ঔদ্ধত্যে আরব, পারসিক ও অন্যান্যরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠে।
তুর্কীদের বিরুদ্ধে অপরাপর দলের মতবিরোধ প্রচণ্ড আকার ধারণ করলে খলিফা বাগদাদ হতে সামারাতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিলেন।
এখানে তুর্কীরা দোর্দণ্ড প্রতাপে খলিফাদের উপর তাদের প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। পরবর্তীকালে তুর্কীদের কবল হতে নিষ্কৃতি লাভের জন্য
রাজধানী স্থানান্তর করে আবার বাগদাদে আনা হয়। খলিফা মুসতাকফি তুর্কীদেরকে দমন করার জন্য বুয়াইদদের সাহায্য গ্রহণ করেন।
কিন্তু এতে তাঁদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় নি। তুর্কীদের প্রধান্য ও ঔদ্ধত্য রাজশক্তির ঐক্যবদ্ধতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল।
তুর্কীদের প্রধান্য :- বিশাল আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রের বাস ছিল। আব্বাসীয় খলিফাগণ তাদেরকে সংঘবদ্ধ করে
একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে নি। হিট্টি বলেন, “সেমিটিক আরবদের সাথে ইরানি, পারসিক, তুরানি সেমিটিক বার্বাররা
কেউই এক গ্রন্থিতে আবদ্ধ হতে পারে নি।” আব্বাসীয় যুগে আরব ও অনারব মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে কোন্দল সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে
দুর্বল করেছিল। আরবগণ যেমন অনারব মুসলমানদেরকে ঘৃণা করত, তেমনি পারসিকরাও আরবীয় মুসলমানদেরকে সুনজরে দেখত না।
আমীনের বিরুদ্ধে মামুনের বিজয়ের ফলে আরবদের উপর পারসিকদের প্রভুত্ব সূচিত হয়েছিল।
অনারবরাও আরবীয়দের প্রতি বিদ্বেষবশত পারসিকদের দলে সংঘবদ্ধ হয়। এতে জাতি ও দলগত বিদ্বেষ ব্যাপক আকার ধারণ করে।
জাতিগত ও দলীয় বিদ্বেষ :- খিলাফত লাভের ক্ষেত্রে কোন সুনির্দিষ্ট উত্তরাধিকার নীতি ছিল না। ফলে একাধিক ব্যক্তি ক্ষমতালাভের
জন্য পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হতেন। রাজপরিবারের সদস্যরাও একে অন্যের পক্ষ সমর্থন করে বিবাদে লিপ্ত হতেন। খিলাফতকে কেন্দ্র করেই আমীন ও মামুনের মধ্যে গৃহযুদ্ধ হয়।
উত্তরাধিকার নীতির অভাব :- খলিফাগণ যদি উত্তরাধিকারী মনোনয়নের ক্ষেত্রে কোন সুনির্দিষ্ট নীতি মেনে চলতেন, তবে রাজপরিবার,
সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে বিরোধ ও মতানৈক্যের কোন অবকাশ থাকত না এবং সাম্রাজ্যের সংহতিও সুদৃঢ় হত।
সামরিক বিভাগের প্রতি অবহেলা :- সামরিক শক্তির উপর সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ও দৃঢ়তা অনেকখানি নির্ভর করে। কিন্তু আব্বাসীয়
খলিফাগণ রাজ্যজয় অপেক্ষা সাম্রাজ্যের অধিবাসীদের মানসিক উন্নতির দিকে বিশেষ জোর দিতেন। সৈন্যগণ শৌর্যবীর্য ও সামরিক শক্তি হারিয়ে ফেলে। সামরিক বিভাগের প্রতি কোন গুরুত্ব না দেয়ার ফলে সাম্রাজ্য বৈদেশিক শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে আব্বাসীয় সৈন্যরা শত্রুদের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারে নি।
কেন্দ্রের শৈথিল্য ও সামন্ত প্রথা :- দুর্বল খলিফাদের আমলে প্রদেশগুলোতে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে। প্রদেশগুলোতে পূর্ব হতেই
সামরিক ও রাজস্বের ব্যাপারে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল। এতে প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ প্রচুর শক্তি ও বিত্ত সঞ্চয়ের সুযোগ পান প্রাদেশিক
সরকারের সাথে কেন্দ্রীয় সরকারের আন্তরিক সম্পর্ক না থাকায় সাম্রাজ্যের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। অনেক সময় সুযোগ বুঝে প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ কেন্দ্রের আনুগত্য অস্বীকার করতেন।
খলিফাগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের দমন করতে ব্যর্থ হতেন। সামন্তপ্রথাও কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থাকে বহুলাংশে দুর্বল করেছিল।
খলিফা হারুন-অর-রশীদ ইপরিকিয়ার শাসনভার ইব্রাহীম আগলাবের উপর স্থায়ীভাবে অর্পণ করেছিলেন। এর ফলশ্রুতিতে সেখানে স্বাধীন আগলাবীয় বংশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
নানা ধর্মীয় মতবাদের জন্ম :- বিরোধিতা: বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় ও ধর্মমতের উদ্ভব আব্বাসীয় খিলাফতের বিপর্যয়ের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল।
মুসলমানদের মধ্যে এ সময় শিয়া, সুন্নী, মু’তাযিলা, গুপ্তঘাতক, কারামতী, ইসমাঈলীয়া প্রভৃতি ধর্মীয় মতবাদের সৃষ্টি হয়।
এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করত এবং এজন্য কখনও কখনও রক্তক্ষয় হত।
আমীনের মন্ত্রী ফজল-বিন-রাবীর সাথে মামুনের মন্ত্রী ফজল-বিন-সাহলের দ্বন্দ্বকে অনেকে সুন্নী ও শিয়ার বিরোধ বলেই মনে করেন।
খলিফাগণও কখনও কখনও একটি বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করতেন, যেমনঃ মামুন মু’তাযিলা মতবাদের সমর্থক ছিলেন।
এতে স্বভাবতই এক সম্প্রদায়ের প্রতি অন্য সম্প্রদায়ের বিরোধ প্রকাশ পেত। মুসলমানদের এ অভ্যন্তরীণ অনৈক্য এবং নানা দলে
বিভক্তি সাম্রাজ্যের ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করেছিল।