You are currently viewing ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ,গুরুত্ব ও ফলাফল
ফ্রান্সে ১৮৪৮ - এর ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ,গুরুত্ব ও ফলাফল

  • ফ্রান্সে ১৮৪৮ – এর ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ :
  • ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের গুরুত্ব ও ফলাফল এবং ইউরোপে তার প্রভাব :

  • ফ্রান্সে ১৮৪৮ – এর ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ :

১৮৪৮-এর ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে কেউ কেউ তদানিতন্ত ফ্রান্সের আর্থনীতিক সংকটের ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, ১৮৪৬-৪৭-এ ফ্লাসে যে খাদ্যাভাব এবং আর্থনীতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল তা কেবল ফ্রান্সের একার ব্যাপার নয়, ইউরোপের প্রায় সব দেশকেই তা কম বেশি আঘাত করেছিল। সুতরাং এমন কথা বলাই সমীচীন যে, রাজনৈতিক এবং আর্থনীতিক সমস্যা মিলিয়েই বিপ্লব ঘটেছিল, যেমন হয়েছিল ১৭৮৯-এর ফরাসি বিপ্লব বা ১৮৩০-এর জুলাই বিপ্লবে। রাজনৈতিক কারণ সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, ১৮৩০-এ ফরাসিবাসীর মনে যে আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়েছিল তা লুই ফিলিপ পূরণে সমর্থ হননি। তাছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যখন বিপ্লবের অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল তখনও তিনি তার সমর্থনে না এগিয়ে ফরাসিবাসীকে হতাশ করেছিলেন। এইভাবে নানা দিক থেকে লুই ফিলিপের বিপদ এসেছিল, যার ফলে ১৮ বছর রাজত্বের পরেই তাঁকে পদত্যাগ করে জনসাধারণকে শান্ত করতে হয়েছিল। জুলাই রাজতন্ত্রের ভিত্তি প্রথম থেকেই ছিল খুব দুর্বল। তার কারণগুলি হল,

প্রথমত, ওই রাজতন্ত্রের পিছনে ফ্রান্সের কোনো প্রভাবশালী দল বা গোষ্ঠীর-ই সমর্থন ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা হল, ফ্রান্সে সেই সময় যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছিল তাদের ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থাকায় লুই ফিলিপের পন্থা কারোকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ বলতে গেলে, ‘প্রজাতান্ত্রিক` বা “রিপাব্লিকান`” দলের সমর্থকরা রাজতন্ত্রের বিরোধী ছিল বলে লুই ফিলিপের শাসনকে তারা স্বৈরতান্ত্রিক বলে মনে করতো। “সমাজতান্ত্রিক” বা “সোস্যালিস্ট” দলের সমর্থকরা কল-কারখানার জাতীয়বদাণ বা শ্রমিক শ্রেণির উন্নতির যে কর্মসূচি তুলে ধরেছিল লুইয়ের পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এই রকম আরও অনেক দল ছিল যাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে লুইয়ের কর্মপন্থার কোনও মিল ছিল না। এইভাবে সবকটি রাজনৈতিক দলই লুইয়ের প্রতি বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছিল।

দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনের অভাবে লুই ফিলিপ ফ্রান্সের উচ্চ-মধ্যবিত্তদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিলেন। শাসনকাজ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে উচ্চ-মধ্যবিত্তদের প্রাধান্য আবার নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং অন্যান্যদের চক্ষুশূল হায় উঠেছিল। এমতাবস্থায় এরা সকলেই লুইয়ের বিরোধিতায় নেমে পড়েছিল যার ফলে শেষ পর্যন্ত ‘জুলাই রাজতন্ত্র’কে আর টিকিয়ে রাখা যায়নি।

তৃতীয়ত, লুই ফিলিপের পররাষ্ট্রনীতিও দেশের উদারপন্থীদের হতাশ করেছিল। উদারপন্থীরা চেয়েছিল যে ফ্রান্স ইউরোপের দলিত জাতিসমূহের সমর্থন ও সাহায্যে এগিয়ে যাক। কিন্তু লুই ফিলিপ এমন নীতি অনুসরণ করেননি। উদারপন্থীরা তাই লুইয়ের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল।

চতুর্থত, ১৮৪৮-এর ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল শ্রমিকদের মধ্যে বিক্ষোভ যা নাকি তাদের প্রজাতন্ত্রীদের সঙ্গে একাত্ম করে তুলেছিল। ত্রিশের দশকেই শিল্প-বিপ্লব বলতে যা বোঝায় ফ্রান্সে তার বিকাশ ঘঠছিল; এবং তার ফলে সেদেশে আধুনিক অর্থে ‘শ্রমিক’ বা ‘প্রলেতারিয়েত’ শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ‘জুলাই রাজতন্ত্র’ কোনোভাবেই এই শ্রমিকদের উন্নতি সাধনে পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তাদের কাজের সময় নির্দিষ্ট করা হয়নি, ন্যূনতম বেতনও নির্ধারিত হয়নি। তাছাড়া শিল্প এলাকায়, বিশেষ করে প্যারিস শহরে, তাদের দুর্বিষহ জীবনযাত্রার উন্নতিকল্পেও,

লুই ফিলিপ-এর সরকার এগিয়ে আসেনি। এমতাবস্থায় প্যারিস, লিও এবং অন্যান্য শহরে শ্রমিক-বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। সরকার চণ্ডনীতির দ্বারা এইসব শ্রমিক বিক্ষোভ দমন করলে নিজেদের স্বার্থরক্ষার্থে শ্রমিকরা প্রজাতান্ত্রিকদের সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিল। কারণ প্রজাতান্ত্রিকরা লুই ফিলিপের সরকারে তীব্র বিরোধী ছিল।

পঞ্চমত, ১৮৪৮-এর ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের অপর একটি প্রধান কারণ ছিল ফ্রান্সের তীব্র অর্থ-সংকট। ফ্রান্সে আরও বহুবার আর্থনীতিক সংকট উপস্থিত হয়েছিল। কিন্তু উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে তার মাত্রা ছিল খুবই বেশি। একদিকে অজন্মার ফলে কৃষি-উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল, অন্যদিকে ব্যাবসাবাণিজ্যে মন্দা দেখা দেওয়ায় শিল্প-উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল। এসবের ফলে কর্মহীন কৃষক ও শ্রমিকদের দারিদ্র্য চরমে পৌঁছেছিল। চারদিকে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল মানুষ। লুই ফিলিপের সরকার এইসব সমস্যার সমাধান করতে পারেনি, আবার বিক্ষোভের মোকাবিলাও করতে পারেনি।

চারদিক দিয়ে অসন্তোষ ও বিক্ষোভের তাড়নায় লুই ফিলিপের প্রধানমন্ত্রী গিজো জুলাই রাজতন্ত্রের নিরাপত্তা বিধানের জন্য এমন কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন যা দমননীতিরই নামান্তর। ১৮৪৮-এর মধ্যেই লুই ফিলিপের সরকার স্বৈরাচারী শাসনের রূপ গ্রহণ করেছিল। যাই হোক, ১৮৪৭-এর পর থেকেই জুলাই রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ তুঙ্গে উঠেছিল। এইসব বিক্ষোভে প্রজাতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, শ্রমিক, ছাত্র সকলেই সামিল হয়েছিল। লুই ফিলিপের সরকার এইসব সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে তার পতনকে অনিবার্য করে তুলেছিলেন। কিছু সংস্কারমূলক কর্মসূচি গ্রহণের জন্য ১৮৪৮ এর ২২ ফেব্রুয়ারি লুইয়ের রাজনৈতিক বিরোধীরা এক ভোজসভায় মিলিত হবার পরিকল্পনা করেছিল। প্রধানমন্ত্রী গিজো এই ভোজসভাকে ‘দানবীয় ভোজসভা’ (‘মনস্টার ব্যাঙ্কোয়েট”) আখ্যা দিয়ে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। নিষেধাজ্ঞা জারি করবার সঙ্গে সঙ্গে জনতার সঙ্গে সরকারি সেনাদলের যে সংঘর্ষ হয় তার মধ্যে দিয়ে লুই ফিলিপের সরকারের পতন ঘটেছিল। ২৩ ফেব্রুয়ারি লুই ফিলিপ ইংল্যান্ডে আশ্রয় নিলে ফ্রান্সে জুলাই রাজতন্ত্রের ইতি ঘটেছিল। ১৮৪৮ এর ফেব্রুয়ারি মাসে এই বিপ্লব অনুষ্ঠিত হওয়ার দরুন তা ‘ফেব্রুয়ারি বিপ্লব’ নামে অভিহিত। আর এই বিপ্লবে প্রধান ভূমিকা ছিল লুই ব্ল্যাঙ্ক-এর। লুই ফিলিপের পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে প্রজাতন্ত্রী এবং সমাজতন্ত্রী দলের নেতৃবর্গ যুগ্মভাবে ফ্রান্সে এক অস্থায়ী বা সাময়িক সরকার গঠন করেছিলেন। এই সরকার প্রথমেই ফ্রান্সকে ‘প্রজাতন্ত্র’ বলে ঘোষণা করেছিল (১৮৪৮)। এই প্রজাতন্ত্র ছিল ফ্রান্সের দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র বা দ্বিতীয় ফরাসি প্রজাতন্ত্র (সেকেন্ড ফ্রেও রিপাব্লিক’)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজা ষোড়শ লুইয়ের কারারুদ্ধ হবার পরে ‘ন্যাশনাল কনভেনশন’ ফ্রান্সকে প্রথমবার ‘প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা করেছিল। সেই অর্থে তা ছিল প্রথম ফরাসি প্রজাতন্ত্র’ (১৭৯২)।

  • ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের গুরুত্ব ও ফলাফল এবং ইউরোপে তার প্রভাব :
  1. ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ফ্লাপে রাজতন্ত্রের অবসান এবং প্রজাতন্ত্রের জয় ঘোষিত হয়েছিল। লুই ব্ল্যাঙ্ক-এর নেতৃত্বে গঠিত ফ্রান্সের অস্থায়ী সরকার সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিল যে, সকলের অর্থোপার্জন-ব্যবস্থা, শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা ও প্রজাতন্ত্রের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করাই হবে অস্থায়ী সরকারের উদ্দেশ্য।
  2. অস্থায়ী সরকার ফ্রান্সের প্রজাতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র রচনার জন্য যে নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেছিল তাতে সার্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছিল। একুশ বছর বয়স্ক ব্যক্তিমাত্রকেই নির্বাচনে ভোটাধিকার দান করা হয়েছিল। এইভাবে ১৮৪৮-এর বিপ্লবের পরবর্তীকালে ফ্রান্সের প্রজাতান্ত্রিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় করবার যাবতীয় ব্যবস্থা অস্থায়ী সরকার গ্রহণ করেছিল। একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, এই সময় থেকেই ফ্রান্সে উচ্চমধ্যবিত্তদের প্রাধান্য লুপ্ত হয়ে জনসাধারণের রাজনৈতিক অধিকার ও তার সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, চরমপন্থী বা সমাজতান্ত্রিকদের ব্যাপক প্রচার সত্ত্বেও আর্থনীতিক সমতার দাবি ফরাসিবাসীর মধ্যে তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। ফরাসি জনগণ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষেই মত প্রকাশ করেছিল। ১৮৪৮-এর ফরাসি নির্বাচন-ই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। নির্বাচনে চরমপন্থী ও সমাজতান্ত্রিকদের ভরাডুবি হয়েছিল।

১৮৪৮ এর ফরাসি বিপ্লব সমগ্র ইউরোপ মহাদেশে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত বিপ্লবের প্রেরণায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। ইউরোপের সর্বত্র আন্দোলন জয়যুক্ত হয়েছিল এমন কথা বলা না গেলেও তার পরবর্তীকালে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের জয়কে সুনিশ্চিত করেছিল।

প্রথমত, ফ্রাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ইতালির বিভিন্ন জায়গায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জোয়ার এনে দিয়েছিল। পিডমন্ট (বা পিডমন্ট-সার্ভিনিয়া) -র অধিবাসীরা তাদের রাজার কাছ থেকে উদারনৈতিক শাসনতন্ত্র আদায় করে নিতে পেরেছিল। সেখানে সামস্ততন্ত্রের যা-কিছু অবশিষ্ট ছিল তার অবসান ঘটেছিল। ব্যক্তি-স্বাধীনতা দৃঢ়ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, ১৮৪৮-এর বিপ্লবতরঙ্গ জার্মানির বিভিন্ন অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে তীব্রতর করে তুলেছিল। প্রাশিয়ার জনসাধারণ শাসন-সংস্কারের দাবীতে সর্বত্র দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু করে দিয়েছিল। জার্মানির ব্যাভেরিয়াতে আন্দোলনকারীরা এক ব্যাপক আন্দোলনের মাধ্যমে রাজার পরিবর্তন পর্যন্ত ঘটিয়েছিল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ফ্রাঙ্কফুর্টে জার্মানির জাতীয়তাবাদীদের সমাবেশ। পরবর্তীকালে জার্মানিতে যে ঐক্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল—এই সমাবেশ তার প্রস্তুতিপর্ব বলা যেতে পারে।

তৃতীয়ত, জার্মানির নিকটবর্তী ডেনমার্ক এবং নেদারল্যান্ডের অধিবাসীরাও ১৮৪৮-এর বিপ্লব আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। আন্দোলনকারীদের চাপে পড়ে ডেনমার্কের রাজা সপ্তম ফ্রেডারিক সংবিধান সভার অধিবেশন আহ্বান করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

চতুর্থত, ১৮৪৮-এর বিপ্লব ইউরোপে মেটারনিক পদ্ধতির চুড়ান্ত পতন ঘটিয়েছিল। ওই বছর মার্চ মাসে এক উচ্ছৃঙ্খল জনতা অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে জড়ো হলে মেটারনিক শেষ পর্যন্ত পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছিলেন। ১৮১৫ থেকে ১৮৩০ পর্যন্ত মেটারনিক তাঁর দমননীতি ও রক্ষণশীলতাকে ইউরোপে কার্যকর করতে সমর্থ হলেও, ১৮৩০ এর পর থেকে তাতে ফাটল দেখা দিয়েছিল। আর ১৮৪৮এ মেটারনিক পদ্ধতির চূড়ান্ত পতন ঘটেছিল।

Leave a Reply