You are currently viewing অষ্টাদশ শতকের গুরুত্ব
অষ্টাদশ শতকের গুরুত্ব

অষ্টাদশ শতকের গুরুত্ব

অষ্টাদশ শতক একদিকে যেমন প্রতাপশালী মুঘল সাম্রাজ্যের পতন দেখেছিল তেমনি আঞ্চলিক শক্তির উত্থান ও অবশেষ বিদেশি বণিককুলের ক্ষমতা দখলকে দেখেছিল। প্রশ্ন হল, এককেন্দ্রিক মুঘল কাঠামোর পতনের মধ্য দিয়ে কি ভারতের সৌভাগ্যরবি অস্তমিত হয়েছিল, না আঞ্চলিক শক্তিগুলির উত্থান বহুদিনের অবদমিত আশঙ্কাকে পূরণ করেছিল ? 

অবশ্য বিদেশিদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা সঞ্চিত হওয়ার মাধ্যমে ভারতের দৈন্যই যে প্রকাশিত হয়েছে—একথা অস্বীকার করার নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কোন্‌টির গুরুত্ব ও প্রভাব কতখানি ?

১৮শ শতাব্দী গ্রেগরীয় পঞ্জিকা অনুসারে ১৭০১ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত সময়কাল। এটি গত ২য় সহস্রাব্দের অষ্টম শতাব্দী। ১ জানুয়ারি ১৭০১ সালে শুরু হয় এবং ৩১ ডিসেম্বর ১৮০০ সালে শেষ হয়। ভারতের ইতিহাসে অষ্টাদশ শতকের গুরুত্ব অপরিসীম। এই শতকের মধ্যে দুইশো বছরের মুঘল সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে এবং ভারতের বাণিজ্যিক অনৈক্য শাসনতন্ত্রের নৈরাজ্য সূত্রপাত হয়। তাই ঐতিহাসিকগণ এই যুগকে Dark Age বা নৈরাজ্যের যুগ বলে চিহ্নিত করেছেন। অষ্টাদশ শতকের যুগ হলো পরিবর্তন ও রাজনৈতিক পালাবদলের যুগ

ভারতের ইতিহাসে অষ্টাদশ শতকের গুরুত্ব বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।

ব্রিটিশ আমলা ও ঐতিহাসিককুল মুঘল সাম্রাজ্যের প্রকৃতি নির্ণয় করতে গিয়ে অভিজাত শ্রেণীর চরিত্র ইত্যাদি নিয়েই অধিকমাত্রায় ব্যস্ত ছিলেন যেমন—উইলিয়ম আরভিন। আবার সার যদুনাথ সরকার আওরঙ্গজেবের ওপরই অধিকমাত্রায় দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখেন। সম্রাটের দাক্ষিণাত্য নীতি ও ধর্মনীতিকেই তিনি সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী করেছিলেন। তাঁরই মতো অধ্যাপক ঈশ্বরী প্রসাদ ও শ্রীরাম শর্মাও আওরঙ্গজেবের ধর্মনীতিকেই মুঘলদের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ বলেছিলেন।

পরবর্তীকালে ড. সতীশ চন্দ্রের মতো মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা অর্থনীতির ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন এবং সেইসঙ্গে সাম্রাজ্যের কাঠামোয়। তিনি সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের পশ্চাতে জাগীরও মনসব-এর সংকটকেই অধিকমাত্রায় দায়ী করেছিলেন।

ড. ইরফান হাবিবও অর্থনৈতিক সমস্যার দিকেই অধিক দৃষ্টি দেন। তাঁর মতে অত্যধিক হারে ভূমিরাজস্ব আদায়ের কারণেই গ্রামীণ সমাজে অসন্তোষ ধূমায়িত হয় ও কৃষক বিদ্রোহ ঘটতে থাকে। মোটামুটি এমনই সিদ্ধান্ত করেছিলেন ড. আতাহর আলি

সতীশচন্দ্রের মতো তাঁরও বিশ্বাস যে, জাগীরের স্বল্পতাই গ্রামীণ জীবনে তথা আমলাতন্ত্রে অস্থিরতা বৃদ্ধি করে। একইসঙ্গে তিনি মনে করেন যে, দাক্ষিণাত্য বিজয়ের মাধ্যমে ভূমিরাজস্বে বৃদ্ধি ঘটেনি কারণ বিরাট এলাকায় কৃষির তেমন সুযোগই ছিল না। ফলে মনসবদার-এর সংখ্যায় বৃদ্ধি ঘটল কিন্তু জাগীর-এ নয়। তবে ড. জন এফ. রিচার্ডস ড. আতাহর আলির এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নন। রিচার্ডস দাক্ষিণাত্যে কৃষির সম্ভাবনা কম ছিল এমন কথা মানতে নারাজ।

১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যু মুঘল সাম্রাজ্যকে পতনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু পতন এক দক্ষ শাসকের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে অকস্মাৎ ঘটে গেল—একথা যে ঠিক নয়, তা আমরা জানি। সাম্রাজ্যের ভাঙন সূচিত হয়েছিল বহু বছর ধরে এবং বহু কারণের সংমিশ্রণে। অষ্টাদশ শতকের ভারত লক্ষ করল এক বিপুল পরিবর্তন, যা পূর্ববর্তী শতকের ঘটনাবলি অপেক্ষা ভিন্নতর।

এই সময়কালের অন্যতম প্রধান ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে নাদির শাহর আক্রমণ যেমন মুঘল ভারতের দৈন্য উন্মোচিত করে দিল তেমনি আঞ্চলিক শাসন গড়ে উঠল সেই সাম্রাজ্যের ক্ষয় ঘটিয়ে।

সাম্প্রতিককালে ঐতিহাসিকরা অষ্টাদশ শতককে ‘দীর্ঘতর’ শতক হিসাবে গণ্য করার পক্ষপাতী। তাঁদের মতে এই শতাব্দীর সূত্রপাত ১৬৮০-র দশকে যখন মুঘল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের সূচনা ঘটছিল। ১৭২০-র দশকের মধ্যে সাম্রাজ্য জুড়ে যে অস্থিরতার অবস্থা চলছিল তাকে বহুলাংশে সদ্য গঠিত আঞ্চলিক রাজ্যগুলি দূর করতে সমর্থ হয়। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে ১৭৫০-এর দশকে যখন ইংরেজ কোম্পানির উত্থানের কারণে রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় নতুন আঙ্গিক সংযোজিত হল

পরবর্তী ছয় কি সাত দশকে কোম্পানি সমস্ত ভারতীয় রাজন্যবর্গকে নিজের অধীনে আনতে সক্ষম হয়। তাই অষ্টাদশ শতক কার্যত সপ্তদশ শতকের শেষ দুই দশক থেকে শুরু করে ঊনবিংশ শতকের অন্তত প্রথম দুই দশক পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রশ্নেই সীমাবদ্ধ ছিল না, অর্থনৈতিক প্রশ্নেও একই ব্যাখ্যা প্রযোজ্য। একথা সত্য যে, মুঘলদের কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হওয়ায় অর্থব্যবস্থাও প্রভাবিত হয়, রাজস্ব কাঠামোয় পরিবর্তন ঘটে ও ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কিন্তু এই চিত্র সারা ভারতে ছিল না। কোনও কোনও অঞ্চলে অবশ্যই আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। ইংরেজ কোম্পানির রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের কারণে দেশীয় বণিকরা নানাভাবে ক্ষতির মুখ দেখেছিল। তথাপি আর্থিক বিকাশের গতি রুদ্ধ হয়নি। এমনকি বাংলাতেও বাণিজ্যিক ও কৃষির বিকাশ ছিল উল্লেখযোগ্য।

ড. আতাহর আলির মতে, অষ্টাদশ শতকের অন্যতম দুই জলবিভাজিকা হল ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশির যুদ্ধ এবং ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দের পানিপথের যুদ্ধ। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সামরিক প্রস্তুতি ও ক্ষমতার দুর্বলতা প্রকট করে। এই যুদ্ধে মুঘল সম্রাটের কোনও ভূমিকাই ছিল না এবং উত্তর ভারতে মুঘলদের উত্তরাধিকার

যারা দাবি করছিল, সেই মারাঠাদের দুর্বলতাও প্রত্যেকে দেখতে পায়। অপরদিকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ঘটনাবলি নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়েছে। বিংশ শতকের গোড়ায় ইংরেজ ঐতিহাসিক এস. সি. হিল মনে। করেছিলেন যে, পলাশিতে ইংরেজরা এক বিপ্লব ঘটিয়েছে। তাঁকে অনুসরণ করে ইংরেজদের মধ্যে বিপ্লব তত্ত্বের ব্যাখ্যা দানের জন্য ধুম পড়ে যায়। তাঁদের বক্তব্য ছিল যে, মুঘল সাম্রাজ্যের ভাঙনের সময়ে যে-নৈরাজ্য দেখা দিয়েছিল ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ঘটনাবলি সেই নৈরাজ্যের যুগের অবসান ঘটায়। অর্থাৎ, অষ্টাদশ শতক একইসঙ্গে আঞ্চলিক শক্তির বিস্তার ও ঔপনিবেশিক যুগের সূচনা ঘটিয়েছিল।

ড. সতীশচন্দ্র পাঞ্জাব বা মারাঠাদের আঞ্চলিক অর্থব্যবস্থা নিয়ে যে-বিবরণী দিয়েছেন, তার দ্বারা এক কেন্দ্রীয় অর্থনীতির অনুপস্থিতিতে আঞ্চলিক অর্থব্যবস্থা গড়ে ওঠার উৎসগুলি দেখিয়েছেন। আবার ড. আবদুল করিম মুর্শিদকুলি খানের শাসনকালে বাংলার নতুন অর্থব্যবস্থা নিয়ে বলেছেন। কোনও অঞ্চলেই কাঠামো এক ধরনের ছিল না। এটা ঘটনা যে, আঞ্চলিক অর্থব্যবস্থার বিকাশ তখন ঘটতে শুরু করেছে এবং গাঙ্গেয় উপত্যকা জুড়ে একই ধারা বহমান। নতুন ধরনের বাজার, ক্রেতা-বিক্রেতা ও স্বার্থগোষ্ঠীর বিন্যাস ঘটল, যে-কাহিনী ড. সি. এ. বেইলি লিখেছেন। অবশ্য ড. বেইলির বক্তব্য ড. ইরফান হাবিব গ্রহণ করেন না।

এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, আওরঙ্গজেবের মৃত্যু সাম্রাজ্যের যাবতীয় মহিমা ও শক্তিকে ধ্বংস করে দেয়। ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোনও শাসনই প্রভাবশালী হতে পারেনি। একাদিক্রমে সম্রাটের পরিবর্তন যে দরবারি রাজনীতির নগ্ন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে প্রকাশ্যে এনে ফেলে দেয় সে ইতিহাস ড. সতীশচন্দ্রের গবেষণায় প্রতিভাত।

১৭১৯ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ শাহের সিংহাসনে আরোহণ এবং সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে অপসারণ—এই দুটি ঘটনা কিন্তু পূর্বেকার অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে সমর্থ হয়নি। ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে নাদির শাহর আক্রমণ এবং কারনালে লজ্জাজনক হার ও পরবর্তী মাসগুলিতে দৈন্য সাম্রাজ্য হিসেবে মুঘলদের ব্যর্থতা যেমন প্রকট করল তেমনি অষ্টাদশ শতকে যে এক পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে, সেটিকেও প্রকট করে তুলল। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে আবদালীর নেতৃত্বে আফগানদের আক্রমণ এমনই চলমান ঘটনার এক অংশ। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে পানিপথে মারাঠাদের পরাজয় ঘটলেও উত্তর ভারতের রাজনীতিতে তাদের দাপাদাপি হ্রাস পেল না। সম্রাট কার্যত তাদেরই অভিভাবকত্বে চলে গেলেন এবং ঊনবিংশ শতকের শুরুতে অর্থাৎ, ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে মারাঠাদের পরাস্ত করে সেই অভিভাবকত্ব অর্জন করল ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি

মুঘল সাম্রাজ্যের চরিত্র কেমন ছিল—এ বিষয়ে দীর্ঘ বিতর্ক আজও জারি আছে। ড. মুজঃফর আলম ও ড. সঞ্জয় সুব্রম্যনিয়মের বক্তব্য যে, এই সাম্রাজ্য ছিল এক সূত্রে গাঁথা কিছু অঞ্চলের সমন্বয় মাত্র এবং এই সমন্বয়ের আকারে কোনও সর্বজনীন রূপ যেমন নেই তেমনি নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়াও ছিল এক-এক স্থানে এক-এক রূপ।

কিন্তু আলিগড়ের ঐতিহাসিকবৃন্দ বিশেষত, ড. আতাহর আলি ও ড. ইরফান হাবিব এই সমন্বয়হীন নিয়ন্ত্রণের তত্ত্ব অস্বীকার করেছেন। তাঁরা মনে করেন যে, মুঘল সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের চাবিকাঠিই ছিল তার কঠোর এককেন্দ্রিকতা। সাম্রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী হতে পেরেছিল একটি কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র (ষা মনসবদার-দের মাধ্যমে কাজ করেছিল), একটি কেন্দ্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত মুদ্রা ব্যবস্থা এবং একটি রাজস্ব ব্যবস্থার জন্য। এইসব প্রক্রিয়াগুলিতে যখন ঘুণ ধরল তখনই সাম্রাজ্যের ভাঙন ত্বরান্বিত হল।

কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার সুযোগে প্রাদেশিক শাসকরা কার্যত স্বাধীনভাবে নিজ নিজ সুবা শাসন করছিলেন। এভাবেই গড়ে ওঠে অযোধ্যা, বাংলা ও হায়দরাবাদ। এইসব প্রদেশগুলি নিজ নিজ অর্থব্যবস্থাকে গড়ে তুলেছিল এবং মুঘল শাসন কাঠামোকেই উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে বজায় রেখেছিল। অন্যদিকে মুঘলদের বিরোধিতার মাধ্যমে দাক্ষিণাত্যে মারাঠা রাজ্য ও উত্তর-পশ্চিমে শিখরাজ্য দুটি গঠিত হয়

তাদেরও অর্থব্যবস্থা একই সঙ্গে বিকাশলাভ করে। যদিও বাহ্যিক দিক থেকে তারা মুঘল বিরোধী তথাপি প্রশাসনিক কাঠামো সবই মুঘলদের অনুসারী ছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভূতপূর্ব মুঘল অভিজাত ও নানা স্বার্থগোষ্ঠী আঞ্চলিক স্তরে আরও স্বাধীনতা লাভ করে ও নিজেদের অবস্থানকে আরও মজবুত করে। এইসব রাজ্যগুলিকে অনেক ঐতিহাসিক মুঘলদের ‘উত্তরাধিকারী রাজ্য’ নামে ডাকতে আগ্রহী। এই উত্তরাধিকারী রাজ্যগুলি কিছুক্ষেত্রে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নানাভাবে ও নানাস্তরে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও বহুক্ষেত্রে রাজ্যগুলির ক্ষমতার কারিগররা ইংরেজদের সহায়কের ভূমিকাও পালন করেছিল। সে কারণেই ইংরেজদের পক্ষে সফল হওয়া সম্ভব হয়।

১৭৫০-এর দশকের পর থেকে পূর্ব ভারত থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে বিদেশি শাসন প্রসারিত হলে ভারতীয় কোনো কাঠামোই নষ্ট হয়ে যায়নি। সবই ইংরেজরা বজায় রেখেছিল এবং সেই কাঠামোর মধ্যেই অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটিয়েছিল। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, এই পরিবর্তনের ফলে সর্বাধিক লাভবান হয় ইংরেজ কোম্পানি ও তার বিপুল সংখ্যক কর্মচারী যারা ব্যক্তিগত বাণিজ্য করত। কিন্তু তাদের সঙ্গী ভারতীয়রাও কম লাভবান হয়নি। ঠিক এমনই অবস্থা ছিল মুঘল শাসনে যেখানে মনসবদার ও স্রফ বা সরাফ সম্প্রদায় নানাভাবে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল।

এ কারণেই অনেকের মতে অষ্টাদশ শতক ভারতের ইতিহাসে কোনও বিপর্যয় নয়, বরং তা ধারাবাহিকতারই দ্যোতক। সেই ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়েই আঞ্চলিক সমৃদ্ধ অর্থব্যবস্থা স্থানে স্থানে বিকশিত হয়। যাঁরা এই মতের প্রবক্তা তাঁদের কেম্ব্রিজ স্কুলের অংশীদার বা ‘সংস্কারবাদী’ ঐতিহাসিক বলার প্রবণতা আছে।

সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের পশ্চাতে মানসিকতা ও সংস্কৃতিরও কিছু অবদান আছে। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে ইউরোপে যে নবজাগরণ ঘটে তার দ্বারা বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ক্ষেত্রে ইউরোপের সামগ্রিক অগ্রগতি ছিল বিপুল। ইউরোপ দ্রুত বিশ্ববাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়। নতুন পৃথিবী থেকে সংগৃহীত সোনা, রুপো ইউরোপের আর্থিক জীবনকে প্রভাবিত করে। সাধারণ মানুষের হাতে জমা হয় বিপুল অর্থ এবং তার দ্বারা প্রাচ্য থেকে তারা মূল্যবান তথা শৌখিন সামগ্রী কিনতে থাকে।

তারই প্রভাবে ভারতের ধনী ও অভিজাত শ্রেণীও মূল্যবান সামগ্রী ক্রয়ে ভালোরকম অর্থ ব্যয় করত। অন্যদিকে সামাজিক পরিবর্তনের কোনও সুযোগ না থাকায় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল মধ্যযুগীয়। এ কারণে শহরের বিকাশ যেমন ঘটেনি তেমনি দেখা যায়নি আধুনিক মনোভাবাপন্ন মানুষ। আতাহর আলির ধারণা—এইসব ঘটনাবলি ভারতকে পশ্চিমি দেশগুলি থেকে বহুযোজন পিছনে ফেলে দেয়।

আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালেই দাক্ষিণাত্যে সাম্রাজ্যকে প্রসারিত করার লক্ষ্যে মারাঠাদের সঙ্গে বিরোধ তীব্র আকার নেয়। বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা জয় করেও ঐক্য স্থাপনের কাজ সম্পন্ন করা যায়নি। তেমনি রাজপুতানায় কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব নিবিড় করতে গিয়ে আওরঙ্গজেব রাজপুতদের মতো দীর্ঘদিনের মিত্রদের শত্রুতে পরিণত করেন।

১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দে মাড়োয়ারের ঘটনা রাজপুত জাতীয় সত্তাকে উসকে দেয় ও তার ফলে মুঘল রাজপুত বিরোধ চলতেই থাকে। অর্থাৎ, সাম্রাজ্যের ভিত্তি যে আঞ্চলিক শাসকবর্গ ও স্বার্থগোষ্ঠীর সহযোগিতা ও শুভেচ্ছার ওপর বহুলাংশে দাঁড়িয়েছিল, সেই কাঠামোটি নড়বড়ে হয়ে পড়ে। ড. বার্নাড এস. কোহন এই আঞ্চলিক ও স্থানীয় শক্তিগুলির প্রভাব নিয়ে লিখেছেন।

অষ্টাদশ শতকে এই কাঠামোয় যে পরিবর্তন ঘটল তার মাশুল সাম্রাজ্যকেই দিতে হয়েছিল। ১৭০২-০৩ খ্রিস্টাব্দ থেকেই মুর্শিদাবাদকে কেন্দ্র করে মুর্শিদকুলি খান এই নতুন আঞ্চলিক শক্তির উত্থান ঘটিয়েছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে কেন্দ্রের বিরোধিতা করেননি। নিয়মমাফিক রাজস্ব বৎসরান্তে কেন্দ্রে পাঠাতে সেই সময়ে তাঁর সমকক্ষ সাম্রাজ্যে দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। এই পদ্ধতি তাঁর উত্তরাধিকারীরাও চালিয়ে যান। কিন্তু আলিবর্দী খানের উত্থানের পর বাংলা কার্যত স্বাধীন হয়ে পড়ে।

কেন্দ্রের কোনও নিয়ন্ত্রণ বাংলার ওপর ছিল না। থাকা সম্ভবও ছিল না। আক্ষরিক অর্থে আলিবর্দী দিল্লির অধীনে একজন সুবাদার হলেও ১৭৪০-এর দশকে দীর্ঘ মারাঠা হাঙ্গামার সময়ে নিজের প্রতিরক্ষার দায় তাকেই বহন করতে হয়। কেন্দ্রের কোনও সমর্থন তিনি লাভ করেননি। এমনকি, ওড়িশা রঘুজী ভোঁসলের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য কেন্দ্রের অনুমোদনের অপেক্ষাও তিনি করেননি।

বেনারস অঞ্চল সম্পর্কে গবেষণা করে বার্নাড কোেহন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, আঞ্চলিক রাজস্ব আদায়কারী ও জমিন্দাররা মিলিতভাবে কেন্দ্রকে আর্থিক দিক হতে দুর্বল করে রাখে। সাম্রাজ্য তখন এতই দুর্বল যে, বিদ্রোহী জমিন্দারদের মোকাবিলাতেও ব্যর্থ। ফলে আঞ্চলিক স্বার্থগোষ্ঠীগুলি কেন্দ্র থেকে স্বাধীন হয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়।

এই জাতীয় পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সম্পদের স্থানাস্তরণ। কেন্দ্র থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে বাণিজ্য তার ভরকেন্দ্রকে স্থানান্তরিত করার ফলে আঞ্চলিক স্তরে অর্থনৈতিক তথা রাজনৈতিক ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের উত্থান ঘটে। ড. অশীন দাশগুপ্ত, বি.আর. গ্রোভার, কারেন লিওনার্ড, স্টুয়ার্ট গর্ডন-প্রভৃতিরা সেই কাহিনীকে বিধৃত করেছেন। কিন্তু আঞ্চলিক স্তরে বাণিজ্যিক জগৎ আর ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণে থাকেনি কারণ বন্দর শহরগুলির বাণিজ্য অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধেই ধীরে ধীরে বিদেশিদের হাতে চলে যায়।

এইভাবে আঞ্চলিক শাসনের যজ্ঞ প্রথম শুরু করেছিলেন দাক্ষিণাত্যের সুবাদার নিজাম-উল-মুলক আসফ ঝা। ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের পূর্বাংশ তিনি নিজস্ব এলাকা হিসেবে শাসন করতে শুরু করেন। অতি দ্রুত তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে গড়ে উঠল আর্কটের স্বাধীন নবাবি।

১৭৫০-এর দশকে অযোধ্যার সুবাদার সফদর জঙ্গের শাসনাধীনে অযোধ্যাও একই পথ অনুসরণ করল। পানিপথের যুদ্ধে অযোধ্যার নবাব বিদেশি আক্রমণকারীদের পক্ষাবলম্বন পর্যন্ত করেছিলেন। এই আফগানরাই মুঘলদের হাত থেকে কাবুল এবং সিন্ধু ছিনিয়ে নিল। তারা মুঘল সম্রাটের নামে আবার সীমান্তবর্তী পাঞ্জাবও শাসন করেছিল। কিন্তু পাঞ্জাবের ইতিহাসের গঠনপ্রকৃতি বদলে গেল। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের পর থেকেই আঞ্চলিক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখা গেল মিসিল-গুলির একতার মাধ্যমে।

অবশেষে ১৭৯০-এর দশকে পাঞ্জাবে গড়ে উঠল স্বাধীন শিখ রাজ্য। পাঞ্জাবের উত্থানের মাধ্যমে যেমন এক আঞ্চলিক ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রশক্তির বিকাশ ঘটেছিল, তেমনি ১৭৬০-এর দশকে সুদূর দক্ষিণের মহীশূরে এক ভাগ্যান্বেষী গড়ে তুলেছিলেন স্বাধীন এক রাজ্য। মহীশূরের হায়দর আলি ও তাঁর পুত্র টিপু সুলতানের মধ্যেই দেখা গিয়েছিল স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার নিরলস প্রয়াস। পাঞ্জাবের সঙ্গে মহীশুরের পার্থক্য ছিল, এই ক্ষেত্রেই। পাঞ্জাবের রঞ্জিত সিংহের উত্থানের পিছনে যেমন আফগান শাসক জামান শাহর ভূমিকা ছিল তেমনি পাঞ্জাবের অস্তিত্ব রক্ষার পিছনে ইংরেজ কোম্পানির ভূমিকা বড়ো কম ছিল না।

১৮০৯ খ্রিস্টাব্দেই কোম্পানি এটা নিশ্চিত করে ফেলে যে, আফগান সীমান্ত দিয়ে ভারত আক্রান্ত হলে তার প্রাথমিক ধাক্কা সামলাবেন রঞ্জিত সিংহ। কিন্তু মহীশূরের প্রতি কোম্পানির দৃষ্টিভঙ্গি এরূপ ছিল না। মনে রাখতে হবে যে, ১৭৪০-এর দশকে কর্ণাটকের নবাবের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করেই সর্বপ্রথম ইংরেজ ও ফরাসি কোম্পানিগুলির যুদ্ধ ভারতের মাটিতে ঘটেছিল এবং সেই পর্বের চরম পরিণতি ঘটে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশিতে। অর্থাৎ, অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ভারতীয় ব্যবস্থায় যে আমূল পরিবর্তন ঘটতে থাকে তার বীজ উপ্ত হয়েছিল কর্ণাটকে। সুতরাং দক্ষিণে ইংরেজদের নজর অনেক সুদূর প্রসারিত ছিল। তারা কোনোমতেই মহীশূরকে স্বীকার করতে পারেনি। অষ্টাদশ শতকের ভারতীয় রাজনীতিতে তাই কাঠামোগত ঐক্য ছিল বলা চলে না। কিন্তু প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মুঘল কাঠামোকে নষ্ট করা সম্ভব হল না। এমনকি, মারাঠারা রাজস্ব আদায় কাঠামো মুঘলদের উত্তরাধিকারী হিসাবেই চালনা করেছিল।

ড. রিচার্ড এম. ইটন দেখিয়েছেন যে, বাংলার মতো কেন্দ্র থেকে দূরবর্তী প্রদেশেও কীভাবে মুঘল ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি দানা বেঁধেছিল। ড. মুজঃফর আলম ও সঞ্জয় সুরমনিয়ম লিখেছেন যে, দক্ষিণে আর্কটের স্বাধীন নবাবি যখন গড়ে উঠছে সেই সময়ে (১৭০০-৩২ খ্রি.) সেখানেও মুঘল কাঠামোকে অনুকরণ করা হয়েছিল। মুঘল শাসন ও তার আমলাতন্ত্রের প্রভাব অষ্টাদশ শতক ছাড়িয়ে পরবর্তী শতকেও ব্যাপ্ত ছিল বলে মনে করা যেতে পারে। বাংলার শাসনভার গ্রহণের পর ইংরেজ কর্মচারীদের মুঘল প্রশাসনিক বিধিব্যবস্থা সম্পর্কে শিক্ষিত করাই ছিল ভারতীয় আমলাদের একটা প্রধান কাজ।

ড. পি. জে মার্শালের মতে, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতের ব্যাপক অংশে কৃষি উৎপাদন ছিল যথেষ্ট সন্তোষজনক এবং বাণিজ্যের বিস্তার ঘটতে থাকায় কৃষিক্ষেত্রের আয়তনও বৃদ্ধি পায়। আর্থিক সমৃদ্ধির সুযোগ যেমন পূর্ববর্তী সময়ের বণিককুল ও অভিজাতদের উত্তরাধিকারীরা লাভ করেছিল তেমনি শহরগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে নতুন এক জমিন্দার ও বণিক শ্রেণী। উত্তর ভারতের প্রেক্ষাপটে ড. সি. এ. বেইলি এই বিষয়ে আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে, এক দল মধ্যবর্তী শ্রেণীর বিন্যাস এই সময়ে ঘটেছিল।

উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটায় সর্বাগ্রে লাভবান হল জমিন্দার শ্রেণী এবং তাদের কোনওভাবে হটানো সম্ভব হয়নি। ড. ইরফান হাবিব লিখেছেন যে, স্বয়ং শিবাজী যে-চৌথ আদায় করতেন তা ছিল নেহাতই জমিদারিস্বত্ত্ব অর্থাৎ উৎপাদনের ১/৪ ভাগ। ঠিক এমনই জমিন্দারী মানসিকতা ও জমিন্দার-দের সমর্থনেই গড়ে উঠেছিল পাঞ্জাবে শিখ রাজ্য, যা ড. মুজঃফর আলমের গবেষণার বিষয়বস্তু। ড. আলম এবং একইভাবে ড. রিচার্ড বার্নেট দেখিয়েছেন যে, দীর্ঘকাল যাবৎ জমিন্দার-দের চলে আসা বিরোধকে কোনোভাবেই দমন করতে না পেরে অযোধ্যার নবাব বাধ্য হয়ে তাদের সঙ্গে আপস করেছিলেন।

ড. জন এফ. রিচার্ডসের মতে, মুঘল রাষ্ট্র একটি যুদ্ধরত রাষ্ট্র ছাড়া কিছু ছিল না। এর ফলে তার কেন্দ্রিকতা ছিল প্রবল এবং রাষ্ট্রযন্ত্র আবর্তিত হত সম্রাটকে কেন্দ্র করে। আকবর যেভাবে অভিজাততন্ত্র গড়ে তুলেছিলেন এবং যে-অভিজাতরা রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রয়োজনে ছিল বিশেষভাবে মূল্যবান—সেই অভিজাততন্ত্র ছিল সামরিক। মনসবদার-দের পদমর্যাদা ও সামরিক শক্তি – উভয়ে মিলে তাদের ব্যক্তিগত বেতন ও শ্রেণীবিন্যাস নির্ধারণ করত। ড. এম. এন. পিয়ারসন এই পদ্ধতিকে কেম্ব্রিজের মতাদর্শ অনুসারে পৃষ্ঠপোষকের পদ্ধতি হিসাবে বর্ণনা করেছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত সম্রাট রাজ্যবিস্তার করতে সমর্থ ততক্ষণ মনসবদার-দের নিরঙ্কুশ আনুগত্য তাঁর প্রতি ছিল। নতুন অঞ্চল জয়ের মাধ্যমে পাওয়া যেত নতুন জাগীর।

কিন্তু আওরঙ্গজেবের রাজত্বকাল থেকে সেই বিস্তার যজ্ঞে ছেদ পড়ল। সমস্যা গভীর আকার নেয় তখন। মনসবদাররা দীর্ঘকাল জাগীর-এর জন্য অপেক্ষারত কিন্তু সেনা পোষণের দায় থেকে মুক্ত নয়। এমতাবস্থায় মনসবদার-রা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে স্বাভাবিক নিয়মে ব্যর্থ হল। যে-কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্র সাম্রাজ্যকে এত দীর্ঘ আয়ু দিয়েছিল সেই আমলাতন্ত্রে ঘুণ ধরতে দেরি হল না।

আবার মুঘল অভিজাতদের বিশেষ কোনো জাতি-চরিত্র ছিল না। মনসবদার-দের মধ্যে ইরানি, তুরানি, আফগান প্রভৃতি বহির্ভারতীয় অভিজাতদের পাশাপাশি ছিল শেখজাদা বা ভারতীয় মুসলমান এবং হিন্দু। হিন্দুদের মধ্যে অবশ্য আকবরের রাজত্বকালে মূলত রাজপুত এবং আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে মারাঠারাই ছিল। আবার মুসলমান অভিজাতদের মধ্যে সুন্নিদের প্রাধান্য থাকলেও শিয়ারা কিছু কম ছিল না। আওরঙ্গজেব বিজাপুর ও গোলকুন্ডা জয়ের তাগিদে ওই দুই অঞ্চলের বেশ কিছু অভিজাতকে মনসব প্রদান করায় মুঘল আমলাতন্ত্রের মূলগত বিভাজন সৃষ্টি হল। হিন্দুস্থানি ও দক্ষিণী—এই দুই ভাগে কার্যত তারা বিভক্ত হয়ে যায়। এভাবে আমলাতন্ত্র দুর্বল হল। যোগ্য শাসকের অভাবের সঙ্গে এই সমস্যা যুক্ত হতে সংকট ত্বরান্বিত হয়েছিল।

মনসবদার দের মধ্যে রেষারেষি নতুন ছিল না। ড. এ. জান ক্যায়সার দেখিয়েছেন যে, সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে মোট ৮০০০ মনসবদার-এর মধ্যে মাত্র ৪৪৫ জন মোট রাজস্বের ৬১ শতাংশ ভোগ করত। অর্থাৎ, বিপুল সংখ্যক মনসবদার-কে কোনোমতে দিন গুজরান করতে হত। তার সঙ্গে যুক্ত ছিল অন্য সমস্যা, শাহজাহানের রাজত্বকাল থেকেই খালিস জমির পরিমাণ ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেতে থাকায় জাগীর-এর পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকে। আওরঙ্গজেবের রাজত্বে সমস্যা ভয়াবহ আকার নেয় এবং তার থেকেই সূত্রপাত হয় জাগীর-এর সংকট। এই সংকট থেকে সাম্রাজ্য মুক্ত হতে পারেনি। এমনকি অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে উত্তর ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা সবকিছুকেই এই সংকট গ্রাস করে নেয়।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল স্থানে স্থানে কৃষক বিদ্রোহ, যেগুলি সপ্তদশ শতকের শেষদিকে ঘটতে শুরু করে। কৃষক বিদ্রোহগুলির অধিকাংশ নেতৃত্ব দিয়েছিল জমিন্দাররা। জমিন্দার শ্রেণীর মাধ্যমেই রাজস্ব আদায় করা হত। তাদের বিদ্রোহ অর্থে – রাজকোষ থেকে শুরু করে জাগীরদার-এর বেতনেও টান পড়া। এই পরিস্থিতিতে জাগীরদার-দের উৎপীড়ন বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তার ফলও হয়েছিল বিষবৎ। ড ইরফান হাবিব মন্তব্য করেছিলেন যে, মুঘল ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার মধ্যে এক অদ্ভূত সমঝোতা লক্ষ করা যায়। ব্যবস্থা এমনই ছিল যে, কৃষক রাজস্ব মেটানোর পরও নিজের পরিবারের ভরণপোষণ ও পরবর্তী চাষের বীজ ও সরঞ্জাম ইত্যাদির বন্দোবস্ত করতে পারত। একই সঙ্গে স্থানীয় জমিন্দার-এর ভরণপোষণও চলত।

কিন্তু এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটায় পূর্বের চেহারায় যেমন কৃষককে পাওয়া গেল না, তেমনি গ্রামীণ পরিবেশেও পরিবর্তন দেখা গেল। জমিন্দার-রা যেমন উত্তরোত্তর রাজস্ব জমা দিতে অনীহা প্রকাশ করল, তেমনি প্রাদেশিক শাসনকর্তারা কেন্দ্রীয় কোষাগারের প্রাপ্য অর্থ দিতে ব্যর্থ হল।

আবার শুরু হয় কৃষক বিদ্রোহ। এইসব কৃষক বিদ্রোহের একটি বিশেষ চরিত্র লক্ষ করা যায়। এগুলি ছিল আঞ্চলিক। যেমন, মহারাষ্ট্রে মারাঠা জাতীয় নেতৃত্বের উদ্ভব ঘটল এই পরিবেশে। পাঞ্জাবে শিখ ও রাজপুতানার পূর্বতন সামন্তপ্রভুদের উত্থানও ঘটল এভাবে। দেখা গেল যে, কৃষক বিদ্রোহগুলির বহুক্ষেত্রে জাতি চরিত্র আছে যেমন, সত্ত্বামী ও বুন্দেলা বিদ্রোহ। যেহেতু জমিন্দার-রা নির্দিষ্ট এলাকায় প্রধান জাতের প্রধান ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে আসত, সেইহেতু স্বজাতের মানুষকে জোটবদ্ধ করা অপেক্ষাকৃতভাবে সহজ ছিল।

ড. বেইলি এবং ড. আলম উভয়েই এই জমিন্দার বিদ্রোহগুলিকে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। এই বিদ্রোহের স্বরূপ বিচার করতে গেলে দেখা যায় যে, অধিকাংশ স্থলেই হিন্দুর বিদ্রোহ, যা মুঘল প্রশাসনের বিরুদ্ধে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, যুগ যুগ ধরে ভারতীয় জমিন্দার শ্রেণী ছিল জাতভিত্তিক এবং যখন তারা বিদ্রোহ করল তখন তারা নিজস্ব সব জাতেরই নেতৃত্ব করেছিল, হিন্দু হিসাবে নয়। এ প্রসঙ্গে ড. হাবিব দেখিয়েছেন কীভাবে জমিদার-রা সংগঠিত হয়েছিল এবং কেন তারা মুঘল সাম্রাজ্যকে আঘাত করেছিল। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, রাজস্ব আদায়ের তাগিদে জমিন্দার-রা বারবার উদ্ধত আচরণ করেছে এবং আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ ভালোমতোই গ্রহণ করেছে।

কিন্তু তখন জমিন্দার-রা হয়ে উঠল এক স্বার্থগোষ্ঠী, কোনও মতেই ধর্মীয় বা জাতের গোষ্ঠী নয়। এই জমিন্দারী বংশপরিচয় নিয়েই মারাঠারা এক শক্তিশালী রাজ্য গড়ে তুলেছিল। এই জাতীয় তত্ত্বকে সামনে রেখে ড. আন্দ্রে উইঙ্ক অষ্টাদশ শতকে মুসলমান সাম্রাজ্যে সামন্ত চরিত্রায়নের তত্ত্বটি পেশ করেছেন।

Leave a Reply