- ইতালির ঐক্য আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা :
- ম্যাসিনি (বা মাহিনী) ও ‘ইয়ং ইতালি’ আন্দোলন :
- ইয়ং ইতালি আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণগুলি হল :
- ইতালির ঐকা-আন্দোলন ও কাউন্ট কায়ুন :
- ইতালির সংযুক্তি ও গ্যারিবল্ডি :
- গ্যারিবণ্ডি :
- ইতালির ঐক্য আন্দোলনের শেষ অঙ্ক :
- ইতালির ঐক্য আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা :
রোমক সভ্যতার জন্মস্থান এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁস’এর পীঠস্থান ইতালি কিন্তু জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে অনেক পিছিয়ে ছিল।
প্রায় সাড়ে তিনশো বছর ধরে ইতালি’ বলতে কোনো দেশ আর বোঝাত না—ইতালি অনেকগুলি ছোট-ছোট রাজ্যে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়েছিল।
এইসব রাজ্যের রাজারা সর্বদাই নিজেদের মধ্যে আত্মঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত থাকতেন।
অভ্যন্তরীণ অনৈক্যের সুযোগে বিদেশি শক্তি নানা উদ্দেশ্য নিয়ে এসে ভিড় করেছিল ইতালিতে।
অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স প্রভৃতি শক্তি ইতালির বিভিন্ন অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
দীর্ঘদিনের এই রাজনৈতিক একঘেয়েমিতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছিল নেপোলিয়ান বোনাপার্ট-এর আমলে।
নেপোলিয়ান ইতালি জয় করে তাকে ফরাসি সাম্রাজ্যভুক্ত করে নিয়েছিলেন। এতে ইতালিবাসীর তেমন সুবিধে কিন্তু হয়নি,
তাদের অবস্থারও পরিবর্তন কিছু ঘটেনি। আগেকার মতোই তারা বিদেশি শক্তির পদানত ছিল।
তবে পরোক্ষভাবে একটা সুবিধে তাদের নিশ্চয়ই হয়েছিল। ইতালির ছোট ছোট রাজ্যগুলি একই শাসনের আওতায় এসেছিল;
ইতালির সর্বত্র একই আইন, একই শাসন প্রবর্তিত হয়েছিল। নেপোলিয়ানের সাম্রাজ্যাধীন থাকবার ফলে ইতালির মানুষ প্রথম বুঝতে পেরেছিল যে,
বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তে ঐক্যবদ্ধ হলে তারা কী মহান শক্তিতে পরিণত হতে পারে।
তাছাড়া নেপোলিয়ানের সাম্রাজ্যভুক্ত থাকাকালীন ইতালির মানুষ গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদী আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়।
কিন্তু নেপোলিয়ানের পতনের পরে ভিয়েনা বৈঠক-এর ইতালিবাসীর নবজাগ্রত জাতীয়তাবোধকে সমূলে আঘাত করেছিল।
ওই সময় থেকেই ইতালির ঐক্য আন্দোলনের সূচনা। ইতালিয় ভাষায় ‘রিসজিমেন্টো’ কথাটির অর্থ পুরুষ্কাদ্বরথ।
গৌরবময় ঐতিহ্যের বাহক ইতালিবাসীরা তাদের মর্যাদা ও ঐক্য পুনরুদ্ধারের সংগ্রামকে তাই ‘রিসর্জিমেন্টো’ বলে অভিহিত করে থাকে।
নেপোলিয়ান বোনাপার্টের পতনের পর ভিয়েনা বৈঠকে ইতালিকে আবার বিচ্ছিন্ন করা হয়।
সমবেত প্রতিনিধিরা প্রাক-বিপ্লব অবস্থার প্রবর্তন করতে গিয়ে ইতালিতে আবার পুরাতন বিদেশি শক্তি এবং সামন্ত রাজাদের ফিরিয়ে এনেছিলেন।
যেমন : ইতালির উত্তরাংশে অস্ট্রিয়াকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল মধ্য-ইতালিতে পোপকে।
দক্ষিণ-ইতালির বিভিন্ন রাজ্য পুরানো সামন্তরাজদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
এ ইভাবে ভিয়েনা বৈঠকের পরে ‘ইতালি’ বলতে আবার বোঝাত কতকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের সমষ্টি |
ইতালির এই রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতাকে বোঝাতে ‘ভৌগোলিক সংজ্ঞা’ কথাটি সমধিক প্রচলিত।
বলা বাহুল্য, নেপোলিয়ানের শাসনাধীন থাকাকালীন ইতালিবাসীদের মনে যে ঐক্যবোধ ও স্বাধীনতাস্পৃহা জাগ্রত হয়েছিল
ভিয়েনা বৈঠকে গৃহীত ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে তা সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল।
উপরন্তু ১৮১৫-র পরে ইতালির স্বৈরাচারী শাসকবর্গ এক অভূতপূর্ব দমননীতির দ্বারা ইতালিবাসীর জাগ্রত জাতীয়তাবোধকে কঠোর হাতে দমনের সব রকম ব্যবস্থা করেন।
এমতাবস্থায় ইতালির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ইতালিবাসীর মনে নিদারুণ এক হতাশার সৃষ্টি হয়েছিল।
ঠিক সেই সময়ে ইতালীয় বুদ্ধিজীবারা তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে ইতালির প্রাচীন গৌরবের কাহিনি প্রচার করে হতাশাগ্রস্ত
ইতালিবাসীর মনে নতুন আশার সঞ্চার করেছিলেন।
কেন্তো, ত্রোয়া বা আজেগলিও’র রচিত ইতালির গৌরব-গাথা প্রেরণা পেয়েই উনিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে
ইতালিতে অনেক গুপ্তসমিতি ও সন্ত্রাসবাদী দল গড়ে উঠেছিল।
ম্যাৎসিনি (বা মাহিনী) ও ‘ইয়ং ইতালি’ আন্দোলন।
কার্বোনারি আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে ইতালি, ঐক্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জোসেফ ম্যাৎসিনি নামে জনৈক দেশপ্রেমিক।
তিনি ১৮০৫-এ ইতালির জেনোয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ইতালির ঐক্য ও স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন।
ম্যাৎসিনি বিশ্বাস করতেন যে, প্রত্যেক জাতিরই মানবসমাজের প্রতি কিছু কর্তব্য রয়েছে।
সেই দায়িত্ব পালন করতে গেলে জাতিকে প্রথমে ঐক্যবন্ধ হতে হবে, স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে, এই লক্ষ্যে
পৌঁছাবার জন্য ম্যাৎসিনি মানুষের নৈতিকগুণ বা সততার ওপরই বেশী আস্থাশীল ছিলেন।
ম্যাৎসিনি তাঁর কর্মপন্থাকে তাই তিনটি শব্দে তুলে ধরেছিলেন: ঈশ্বর, জাতি, মানব”।
ম্যাৎসিনির রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল ইতালিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।
যাই হোক, ম্যাৎসিনির আদর্শ ও কর্মপন্থা ইতালিবাসীর মধ্যে এতই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে কেউ-ই তা থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি।
প্রথম জীবনে ম্যাসিনি কার্বোনারি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তিনি সন্ত্রাসবাদের ঘোরতর বিরোধী হলেও ইতালির ঐক্য আন্দোলনের একমাত্র সংগঠক হিসাবেই তাতে যুক্ত হন।
তাছাড়া ওই সময়ে তাঁর চিন্তাধারাও পরিণত রূপ গ্রহণ করেনি। যাই হোক, অল্পদিনের মধ্যেই তিনি কার্বোনারি আন্দোলনে ব্যর্থতা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হয়েছিলেন।
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, আদর্শহীন কার্বোনারিরা কেবল গুপ্ত-হত্যা ও সন্ত্রাসবাদের দ্বারা ইতালির মানুষকে ঐক্যবন্ধ করতে পারবে না।
তবে ইতিমধ্যে কার্বোনারিদের সঙ্গে যুক্ত থাকবার অপরাধে ম্যাৎসিনিকে দেশ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
নির্বাসিত হবার আগে ম্যাৎসিনিকে কিছুদিন কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল। কারাগারে থাকাকালীন-ই তাঁর উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থা সুস্পষ্ট রূপ গ্রহণ করেছিল।
আর তা থেকেই জন্ম নিয়েছিল ইতালিতে ‘ইয়ং ইতালি’ বা ‘যুব ইতালি’ আন্দোলন।
১৮৩২-এ তিনি ‘ইয়ং ইতালি’ নামে একটি যুবসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন।
ই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি দেশের জন্ম আত্মত্যাগ এবং জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দেশবাসীকে অবহিত করেন।
ইতালির যুবসম্প্রদায়কে যদি স্বাধীনতা-সংগ্রামে সামিল করা যায় তাহলে ইতালির ঐক্য ও মুক্তি মোটেই একটা অসম্ভব ব্যাপার নয়।
চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত যে-কোনো ব্যক্তি ইয়া ইতালি’র সদস্য হতে পারত।
ম্যাৎসিনির নেতৃত্বে “ইয়ং ইতালি’ আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, দেশে এমন একদল যুবকের সৃষ্টি করা যারা দেশের
জন্য সর্বদা সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকবে।
ইতালির ঐক্যের প্রধান অন্তরায় ছিল অস্ট্রিয়া। সুতরাং ইয়ং ইতালি আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি চেয়েছিলেন অস্ট্রিয়াকে বিতাড়িত
করে ইতালিকে তার প্রভাবমুক্ত করতে। ম্যাৎসিনি বিশ্বাস করতেন যে, অস্ট্রিয়াকে বিতাড়িত করতে ইতালিবাসীর বিদেশি
কোনো শক্তির সাহায্য দরকার নেই। দেশের ঐক্যবদ্ধ যুবশক্তি নিজ ক্ষমতার দ্বারাই স্ট্রয়াকে যুদ্ধে পরাজিত করতে সমর্থ হবে।
ইতালির যুবশক্তির কাছে অস্ট্রিয়ার সামরিক শক্তি অতি নগণ্য বলে প্রমাণিত হবে। জনগণের সার্বভৌমত্বে
বিশ্বাসী ম্যাসিনি স্বাধীন ইতালিতে প্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠনের পক্ষপাতী ছিলেন।
আদর্শবাদ এবং কর্মধারাকে যুক্ত করে ম্যাৎসিনি যে ইয়ং ইতালি আন্দোলন শুরু করেছিলেন তার প্রথম অগ্নিপরীক্ষা হয়েছিল ১৮৩৩-এ।
ওই বছর ইতালির মাসাই’তে এক গুপ্ত ষড়যন্ত্রে ইয়ং ইতালির সভ্যরা স্যাভয় আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন।
এই পরিকল্পনা অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। কেবল তা-ই নয়, সেই সময় থেকে পর পর এই রকম আরও অনেক পরিকল্পনাই ব্যর্থ হয়েছিল।
এর ফলে ১৮৩৬-এর মধ্যেই ইয়ং ইতালি আন্দোলনের ব্যর্থতা সকলের কাছেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
ম্যাৎসিনি নিজেও পরের বছর ইংল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও ম্যাৎসিনির অনুগামীরা প্রায়শই বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থানের
আয়োজন করে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,
১৮৪৮-এর ‘বিপ্লবের বছরে’ ইতালিতে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ম্যাৎসিনির অনুগামীরা।
ততদিনে অবশ্য ‘ইয়ং ইতালি’ নামে সংগঠিত আন্দোলনের আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না।
- ইয়ং ইতালি আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণগুলি হল :
- ম্যাৎসনির আদর্শবাদ সত্ত্বেও কার্বোনারিদের সঙ্গে | ইয়ং ইতালির কর্মপন্থার তেমন কিছু পার্থক্য ছিল না।
- কার্বোনারিদের সন্ত্রাসবাদ যেমন ব্যর্থ হয়েছিল ইয়ং ইতালির | সামরিক অভ্যুত্থানও তেমনি সফল হতে পারেনি।
- ভাবাবেগ এবং আদর্শবাদ দিয়ে অস্ট্রিয়ার মতন শক্তিশালী দেশের | বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব ছিল না।
- অস্ট্রিয়ার সামরিক বাহিনী তাই অতি সহজে ইয়া ইতালি আন্দোলনকে দমন করেছিল।
- কার্বোনারিদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েও ইয়ং ইতালি আন্দোলনকে গণমুখী করে তোলা যায়নি।
- জনসাধারণের সমর্থনের অভাব আন্দোলনের ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ।
ইয়ং ইতালি আন্দোলনের ব্যর্থতা দিয়ে অবশ্য ম্যাৎসিনির অবদানকে ছোটো করে দেখা ঠিক হবে না। প্রথমত,
মানসিক দিক দিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ও হতাশাগ্রস্ত ইতালিবাসীর মনে তিনিই প্রথম এক নতুন আশা-উদ্দীপনা সঞ্চার করেছিলেন।
দ্বিতীয়ত, অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইয়ং ইতালির ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে একথা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, বিদেশি শক্তির সাহায্য
ব্যতীত ইতালির ঐক্য সম্ভব হবে না। এই সত্যটি উপলব্ধি করেই পরবর্তীকালে কাতুর তাঁর রাজনৈতিক দাবাখেলায় খুঁটি সাজিয়েছিলেন।
তৃতীয়ত, ইয়ং ইতালির ব্যর্থতার পরেও তাঁর অনুগামীরা ওই পথে আন্দোলন চালিয়ে সফল হয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে প্যালেরমো’র
বিদ্রোহের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। আন্দোলনের চাপে পড়েই নেপলস্-এ রাজা দ্বিতীয় ফার্ডিনান্ড সিসিলিতে উদারনৈতিক
সংবিধান ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সবশেষে বলা যেতে পারে যে, অখণ্ড ইতালি গঠনের জন্য যে মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল
ইতালিবাসীর মধ্যে তা সম্পূর্ণ করেছিলেন বলেই তারা পরবর্তীকালে বৃহত্তর আন্দোলনে জয়যুক্ত হতে পেরেছিল।
সেইজন্যই ম্যাংসিনি ইতালির ঐক্য আন্দোলনের পথিকৃৎ’ হিসাবে বন্দিত।
ইতালির ঐকা-আন্দোলন ও কাউন্ট কায়ুন :
‘ইয়ং ইতালি’ আন্দোলনের ব্যর্থতার পরে ইতালির ঐক্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেছিলেন কাউন্ট ক্যামিলো বেনসো ডি কাড়ুর।
তিনি অবশ্য কাউন্ট কাভুর নামেই সমধিক প্রসিদ। ১৮১০-এ ডুবিনের সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে তাঁর জন্ম।
কর্মজীবনে প্রথমে তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে পিডমন্ট-এর রাজকীয় সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেছিলেন।
পরে তিনি পদত্যাগ করে বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। এই সময়েই তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের সূত্রপাত।
প্রজাতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি তাঁর যেমন আস্থা ছিল না,
তেমনি স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রকে তিনি খুবই অপছন্দ করতেন। আসলে তিনি নিজে ছিলেন একজন উদারপন্থী এবং ঐক্যবদ্ধ ইতালি
গঠনের প্রধান সৈনিক। বিদেশ ভ্রমণকালে তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ইতালির ঐক্যের সমর্থনে কয়েকটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন।
এই প্রসঙ্গে তাঁর (জেসারে বালবুর সঙ্গে যুগ্মভাবে) প্রকাশিত ‘রিসর্জিমেন্টো’ পত্রিকার উল্লেখ করা যেতে পারে।
১৮৪৭ নাগাদ কান্ডুর পিডমন্টের আইনসভায় যোগদান করেন, এবং কিছুদিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী পদে উন্নীত হন।
- কাভুর নিজ দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ধরন থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, বিদেশি শক্তির সাহায্য ব্যতীত ইতালির
- ঐক্য আন্দোলন জয়যুক্ত হবে না। সেইজন্য ইতালির জাতীয় সমস্যাকে তিনি ইউরোপীয় সমস্যাতে পরিণত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
- তিনি চেয়েছিলেন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতির সমর্থন নিয়ে অস্ট্রিয়াকে ইতালি থেকে বিতাড়িত করতে।
- তিনি বিশ্বাস করতেন যে, পিডমন্ট-এর নেতৃত্বেই সমগ্র ইতালিকে ঐক্যবন্ধ করা সম্ভব।
যাই হোক, ১৮৫২-তে পিডমন্ট-এর রাজা দ্বিতীয় ভিক্টর ইমান্যুয়েল কাভুরকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করলে তিনি উপযুক্ত নীতি
অনুসারে ইতালির একত্রীকরণের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দান করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইতালির পিডমন্ট রাজ্য সার্ডিনিয়া নিয়ে
গঠিত ছিল বলে তাকে ‘পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া’ও বলা হত।
পিডমন্টের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কাতুর প্রথমেই নানাবিধ সংস্কার প্রবর্তন করে তাকে এক আদর্শ রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। অর্থাৎ পিডমন্টকে
এমন-ই এক শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত করা হয়েছিল যাতে সে ইতালির ঐক্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারে। কৃষি-শিল্পের উন্নতি,
রেলপথ নির্মাণ, সামরিক ও নৌ-শক্তি বৃদ্ধি প্রভৃতির মাধ্যমে কাভুর পিডমণ্ট রাজ্যকে এক নবজীবন দান করেছিলেন।
তাছাড়া চার্চের ক্ষমতাকে কমিয়ে এনে পিডমন্টকে এক আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছিল।
আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধিকল্পে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিও সম্পাদন করা হয়।
এইভাবে পিডমণ্টকে ইতালির অগ্রণী রাজ্যে পরিণত করবার পরে কাভুর ইতালির ঐক্য সমস্যাকে ইউরোপীয় সমস্যায় পরিণত করতে চেয়েছিলেন।
অর্থাৎ ইতালি থেকে প্রধানত অস্ট্রিয়াকে বিতাড়িত করতে ইউরোপীয় শক্তিরা যাতে পিডমন্টের পাশে দাঁড়ায় সেই ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন কাতুর।
এই উদ্দেশ্যকে সফল করে তুলতে কাতুর দু’ভাবে এগিয়েছিলেন। প্রথমত, তিনি ইউরোপের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ইতালির মানুষের
আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা, ইতালির ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছিলেন যাতে ইতালির সপক্ষে জনমত জাগ্রত হয়।
দ্বিতীয়ত, ইতালির ঐক্যের ব্যাপারে ইউরোপীয় শক্তিবর্গের সমর্থন লাভের আশায় এবং অস্ট্রিয়াকে মিত্রহীন করে তোলবার
জন্য কাতুর ইউরোপীয় যুদ্ধে অংশ নিতে শুরু করেন। ইতিমধ্যে সুযোগও এসে গিয়েছিল।
ইউরোপে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (১৮৫৪-৫৬) বেঁধে গেলে কাচুর তাতে যোগদান করেছিলেন। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে পিডমন্টের মতন ক্ষুদ্র
দেশের অংশগ্রহণে ইউরোপীয় রাজনীতির তেমন ক্ষতি-বুদ্ধি কিছু হয়নি। তা সত্ত্বেও যুদ্ধে অংশ নিয়ে পিডমন্টের লাভ হয়েছিল এই যে,
সে ক্লাইমিয়ার যুদ্ধাবসানে স্বাক্ষরিত প্যারিস-এর চুক্তিতে সমানভাবে অন্যান্যদের সঙ্গে যোগদান করতে পেরেছিল।
তাছাড়া কাভুর এই শান্তি সম্মেলনে ইতালির পক্ষে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের সহানুভূতিলাভে সমর্থ হয়েছিলেন।
১৮৫৮-তে এই সহানুভূতি একটা পরিণতিতে এসে পৌঁছেছিল। ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ান ১৮৫৮-তে গ্লোম্বিয়ার্স-এর চুক্তিতে
এই মর্মে স্বীকৃত হয়েছিলেন যে, তিনি অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে পিডমন্টকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবেন। ফ্রান্সের সহযোগিতার আশ্বাস
পেয়ে কাভুর অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে সমরসজ্জা শুরু করেছিলেন। অস্ট্রিয়া এই ব্যাপারে আপত্তি জানালে পিডমন্ট তা গ্রাহ্যের মধ্যে আনেনি।
এমতাবস্থায় কাত্তুরের আকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।
১৮৫৯-এ অস্ট্রিয়া-পিডমণ্ট যুদ্ধ বেঁধে গেলে ফ্রান্সের তৃতীয় নেপোলিয়ান কাভুরকে প্রতিশ্রুতিমতো সামরিক সাহায্য প্রেরণ করেছিলেন।
ম্যাজেন্টা এবং সলফেরিনো’র যুদ্ধে পিডমন্টের সৈন্যরা অস্ট্রীয় সৈন্যদের বিষাক্ত করে লম্বার্ডি ও মিলান দখল করে নিয়েছিল।
উৎসাহিত হয়ে কাভুর সেই সময়ে ভেনিশিয়া আক্রমণে উদ্যত হলে তৃতীয় নেপোলিয়ান আকস্মিকভাবে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ভিন্নাফ্লাঙ্কা’র
সন্ধি স্বাক্ষর করে বসেন। কেবল তা-ই নয়, তিনি তখন অস্ট্রিয়ার সঙ্গে বিরোধ ও সংঘর্ষ মিটিয়ে ফেলবার জন্য
পিডমন্টের ওপর চাপ-ও সৃষ্টি করতে থাকেন।
কাভুর এতে সম্মত হননি। কিন্তু পিডমন্টের রাজা দ্বিতীয় ভিক্টর ইমান্যুয়েল যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছিলেন, এবং একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে,
এই ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কাভুর অপেক্ষা তিনি অধিকতর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন যে, নানা বাধা-বিঘ্নের মধ্যে ধীরে ধীরে ইতালিকে ঐক্যবন্ধ করতে হবে। সুতরাং পরিস্থিতি বিবেচনায় অস্ট্রিয়ার সঙ্গে “জুরিখ” এর সন্ধি স্বাক্ষর করে তিনি যুদ্ধ-বিরতি ঘটিয়েছিলেন। এর প্রতিবাদে কাড়ুর পদত্যাগ করেছিলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি অবশ্য স্বপদে প্রত্যাবর্তন করেন।
যাই হোক, ইতালিবাসীর মনে সেই সময় যে জাতীয়তাবাদের জোয়ার বইছিল ‘ভিন্নাফ্রাঙ্কার সন্ধি’ তার গতিরোধ করতে পারেনি।
১৮৬০-এ মধ্য-ইতালির পার্মা, মোডেনা, টাস্কেনি প্রভৃতি ইতালীয় রাজ্য পিডমন্টের সঙ্গে যুক্ত হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল।
এই সংযুক্তিতে তৃতীয় নেপোলিয়ান যাতে আপত্তি করতে না পারে তার জন্য এক সমঝোতায় স্থির হয়েছিল
যে ফ্রান্সকে স্যাভয় এবং নিস দেওয়া হবে।
আর বিনিময়ে তিনি ওই সংযুক্তিতে আপত্তি করবেন না। পার্মা, মোডেনা প্রভৃতি রাজ্যের লোকেরা গণভোটের মাধ্যমে
পিডমন্টের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় ইতালির একত্রীকরণ আরও একধাপ এগিয়ে গিয়েছিল।
ইতালির ঐক্য আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায় হল নেপলস ও সিসিলি’-র পিডমন্ট রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্তি।
তবে নেপলস এবং সিলিকে বুর্বো শাসন থেকে মুক্ত করবার কৃতিত্ব কিন্তু গ্যারিবন্ডির প্রাপ্য।
আপাতত সেই কাহিনি স্থগিত রেখে বলা যেতে পারে যে কাতুর, গ্যারিবন্ডির পরিকল্পনায় বাদ সেধে সাময়িকভাবে ইউরোপীয় যুদ্ধকে এড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন।
কাতুর সময়মতো মুক্ত সিসিলি-নেপলসকে গ্যারিবন্ডির হাত থেকে ছিনিয়ে এনে অর্জিত ইতালির ঐক্যকে সুসংহত করেছিলেন।
কেবল তা-ই নয়, পিডমণ্ট থেকে সৈন্য প্রেরণ করে তিনি রোম ব্যতীত পোপের রাজ্যের সবটা দখল করে নিয়েছিলেন।
এইভাবে ১৮৬১-তে ভেনিশিয়া এবং রোম ব্যতীত সমগ্র ইতালি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ওই বছরই কাভুর মৃত্যুমুখে পতিত হন।
ইতালির একত্রীকরণে কাত্তুরের ভূমিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, কার্বোনারি এবং ইয়ং ইতালি আন্দোলনে ব্যর্থতার পরে
তাঁর বাস্তবসম্মত পরিকল্পনাতেই ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হয়েছিল।
ইতালির ঐক্য সমস্যাকে ইউরোপীয় সমস্যায় পরিণত করে তিনি ইউরোপের বৃহৎ শক্তিবর্গ যেমন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি
দেশের সমর্থন আদার করে নিতে পেরেছিলেন।
ইউরোপের সমসাময়িক জটিল পরিস্থিতিতে ইতালির ঐক্য সাধন যে একটা দুরূহ ব্যাপার ছিল তা উপলব্ধি করেই গ্ল্যাডস্টোন
ইতালির ঐক্যকে সমসাময়িক ইউরোপের “বিস্ময়কর ঘটনা” বলে উল্লেখ করেছেন। আর এই ব্যাপারে কাত্তুরের কৃতিত্ব সকলেই স্বীকার করে নিয়েছেন।
সবশেষে বলা যেতে পারে যে, কাতুর একজন উদারপন্থী হলেও প্রজাতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি তার তেমন আস্থা ছিল না।
কাত্তুরের উদারপন্থা ইতালিতে যে ব্যক্তিকেন্দ্রীক রাজনীতির সূচনা করেছিল তা থেকেই পরবর্তীকালে সেখানে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছিল বলে অনেকে মনে করেন।
- ইতালির সংযুক্তি ও গ্যারিবল্ডি :
গ্যারিবল্ডি’র অবদানকে অস্বীকার করে ইতালির ঐক্য আন্দোলনকে ব্যাখ্যা করা যায় না। ইতালি ধাপে ধাপে ঐক্যবন্ধ হয়েছিল,
একই সময়ে সমগ্র ইতালি ঐক্যবদ্ধ হয়নি। আর এই ব্যাপারে ম্যাৎসিনি, কাভূর ও গ্যারিবল্ডি—এই ত্রয়ী নেতৃত্বের কারো অবদানকেই
ছোট করে দেখা সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আদর্শ ও কর্মপন্থার বিচারে ম্যাৎসিনি ও গ্যারিবণ্ডি পরস্পর যতটা কাছের ছিলেন, কাতুর থেকে উভয়ের দুরত্ব ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি। ম্যাৎসিনি এবং গ্যারিবন্ডি প্রজাতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।
তাছাড়া উভয়ের আদর্শগত মিল ছিল বলে গ্যারিবল্ডিকে ‘ম্যাৎসিনীয়’ বা ম্যাৎসিনির মস্ত্রশিষ্য বলা হত। কিন্তু কাড়ুর ছিলেন উদারপন্থী।
রাজতন্ত্রের একজন সমর্থক হলেও তিনি রাজার স্বৈরাচারী ক্ষমতার বিরোধী ছিলেন। যে কারণে দেখা যায় কাড়ুর পিডমন্টের রাজাকে
(দ্বিতীয় ভিক্টর ইমান্যুয়েল) নিয়মের বাঁধনে বেঁধে রেখেছিলেন। যাই হোক, অল্প কথায় বলতে গেলে, কাভুর যেখানে পিডমন্টে রাজার নেতৃত্বে ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন সেখানে ম্যাৎসিনি ও গ্যারিবস্তি চেয়েছিলেন ইতালিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে।
গ্যারিবণ্ডি :
ইতালির মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সৈনিক গ্যারিবন্ডির একটা সামরিক অতীত ছিল। যুবক বয়সে তিনি এক সময় নৌ-সেনাদলে যোগদান করেছিলেন।
ম্যাসিনির স্বাধীন ইতালির স্বপ্ন নিয়ে তিনি একবার সন্ত্রাসবাদী ষড়যন্ত্রে যুক্ত হন। মৃত্যুদণ্ড আদেশ পেয়ে গ্যারিবণ্ডি দক্ষিণ আমেরিকাতে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে উরুগুয়ের মুক্তি যুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন, এবং ১৮৪৬-এ স্বাধীন ও প্রজাতান্ত্রিক উরুগুয়ে প্রতিষ্ঠায় তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল।
সেখানেও গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে তিনি এই ব্যাপারে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এমনকী, তাঁকে উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ
গেরিলা নায়ক হিসাবেও বর্ণনা করা হয়। যাই হোক, ১৮৪৮-এ স্বদেশ নিস’এ ফিরে এসে তিনি দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
ইতালির ঐক্য এবং মুক্তি তাঁর লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ইতালির ঐক্য আন্দোলনে গ্যারিবল্ভির সুযোগ এসেছিল ১৮৬০-এ। ওই বছর সিসিলি এবং নেপলস-এ এক দাঙ্গা বেঁধে যাওয়ায় তিনি
সেখানে তাঁর বিখ্যাত ‘মিলে’ বা ‘এক হাজার’ বাহিনী নিয়ে সিসিলি অভিমুখে রওনা হন। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, সিসিলি ও নেপলস
(যুগ্মভাবে ‘কিংডম অব টু সিসিলিস’ বা দুই সিসিলির রাজ্য) সেই সময়ে ছিল বুরবোঁ শাসনাধীন। বুর্বো বংশের জনৈক দ্বিতীয় ফ্রান্সিস সেখানে রাজত্ব করছিলেন। এই রাজত্বের বিরুদ্ধে এক গণ-বিদ্রোহ শুরু হলে গ্যারিবল্ডি বিদ্রোহীদের সমর্থনে সেখানে উপস্থিত হন।
তাঁর ‘এক হাজার সৈন্য (যদিও একজন নারী সদস্যকে নিয়ে বাহিনীতে মোট সৈন্য ছিল ১০৮৯) সেখানে জনসাধারণের মধ্যে
এক অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়ে তুলেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘এক হাজার সৈন্য ‘লাল কোর্তা’ বা ‘রেড সার্ট’ নামেও অভিহিত হত।
যাই হোক, দু-এক মাসের মধ্যেই বুর্বো বাহিনীকে পরাজিত করে গ্যারিবল্ডি সিসিলি-নেপলসকে মুক্ত করেছিলেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা গ্যারিবল্ডিকে কাত্তুরের | রাজনীতির কাছে হার মানতে হয়েছিল।
পাছে গ্যারিবন্ডি সিসিলি-নেপলসে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে পিডমন্টের রাজার নেতৃত্বে ইতালির ঐক্য সাধনে বাধার সৃষ্টি করেন
সেইহেতু কাড়ুর রাজা দ্বিতীয় ভিক্টর ইমান্যুয়েলকে সেখানে পাঠিয়ে সিসিলি-নেপলসের সমর্পণ দাবি করেন। ইতিমধ্যে এক গণভোটেও সেখানকার লোকেরা স্থির করেছিল যে তারা পিডমন্টের সঙ্গে সংযুক্ত হতে চায়। গ্যারিবন্ডির প্রজাতান্ত্রিক আদর্শ সত্ত্বেও জনসাধারণের ইচ্ছাকে তিনি সম্মান দিয়েছিলেন। সিসিলি-নেপলসের শাসন দ্বিতীয় ভিক্টর ইমান্যুয়েলের হাতে তুলে দিয়ে তিনি দেশভক্তি ও দেশাত্মবোধকে ব্যক্তিগত আদর্শবাদের ওপরে স্থান দিয়েছিলেন। এইখানেই গ্যারিবল্ডির কৃতিত্বের সবচেয়ে বড় দিক।
- ইতালির ঐক্য আন্দোলনের শেষ অঙ্ক :
১৮৬১-তেই বিচ্ছিন্ন ইতালি মোটামুটিভাবে এক ঐক্যবন্ধ রূপ গ্রহণ করেছিল। ঐ বছরই দ্বিতীয় ভিক্টর ইমান্যুয়েল নিজেকে
আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ইতালির রাজা’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। তবে ভেনিশিয়া এবং রোম তখনও ইতালির সঙ্গে যুক্ত হওয়া বাকী রয়েছিল। ভেনিশিয়া এবং রোম-এ যথাক্রমে অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের সামরিক বাহিনী মোতায়েন থাকার ফলে ওই দুই দেশের সঙ্গে যুদ্ধ ব্যতীত ইতালিকে সম্পূর্ণভাবে ঐক্যবন্ধ করা সম্ভব ছিল না। তবে সমসাময়িক ইউরোপীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ঐ দুটি অঞ্চল অতি সহজভাবেই ইতালির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিল।
১৮৬৬-তে প্রাশিয়ার বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ইতালি প্রাশিয়ার পক্ষ অবলম্বন করেছিল।
অস্ট্রিয়া-প্রাশিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত স্যাডোয়ার যুদ্ধে অস্ট্রিয়া পরাজিত হলে তাকে ভেনিশিয়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল। অনুরূপভাবে ১৮৭০-এ প্রাশিয়া-ফ্রান্সের মধ্যে অনুষ্ঠিত সেডানের যুদ্ধে ইতালি প্রাশিয়াকে সমর্থন করেছিল। এই যুদ্ধে ফ্রান্স পরাজিত হয়ে রোম থেকে সৈন্যবাহিনী তুলে নিলে রোম ইতালির সঙ্গে সংযুক্ত হয়। প্রকৃতপক্ষে সেডান’এর রণাঙ্গন (১৮৭০) থেকেই এক সম্পূর্ণভাবে ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন ইতালি জন্ম নিয়েছিল।